কর্তন সম্ভাব্য চুলের জন্য শোক
করোনা দিনকালে আদম সুরতের (চেহারা মোবারকের) হালহকিকত বড় খারাপ। বড় বেসামাল। সেলুনে যাওয়া খুব জরুরি। কিন্তু যেতে চাইলেই কি যাওয়া যায়? আর সেলুনগুলো তো এখনো লক ডাউনের কবলে। অন্তরীণ ক্ষৌর কার্য সামগ্রী যেমন—ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি ও ট্রিমার তো অন্ধকার হিমঘরে ঘুমায়। ওদের তো ক্ষুধা পায় না, খেতে খেতে-টেতে হয় না। কিন্তু এই সুদীর্ঘ করোনা-হিম-শীত নিদ্রাকালে একঘরে বাস করা সঙ্গী ইঁদুর ও আরশোলার পেটে ক্ষুধা চাগিয়ে ওঠে। এই দুর্ভিক্ষ, মঙ্গাকালে কৃচ্ছ্রসাধন তাদেরও করতে হয় বৈকি! তাই ‘দিনে একবেলা খাবার সই’ মেনে সাঁজবাতি দিতে গেলেই সবাই জেগে যায়। তখনই ঘরের সকলে মিলে একটু যা গপ্প-গুজব হয়! সত্যি বলতে কি গল্প আর কোথায়, সবটাই গুজবের কথা।
সেলুনটার গা ঘেঁষা গ্রোসারি স্টোর। মাস আড়াই লকডাউনের লকড্ থাকায় সাড়া-শব্দ ছিল না। এখন খুলে দিয়েছে। শোনা যায় গ্রোসারি দোকানগুলোতেই নাকি করোনাভাইরাস সুবিধা করতে পেরেছে বেশি। সেখান থেকেই ছড়িয়েছে বেশি। তাই খোলার সময় নানা নিয়মকানুন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অবশ্য সকলের জন্যই। সব জায়গার জন্যই বেঁধে দিয়েছে সরকার ও প্রশাসন। ব্যাংক, বিমা, অফিস বাঁধা নিয়ম অনেকখানিই মানছে। সুপার মার্কেট, ফার্মেসি—এরা খানিকটা মানছে, খানিকটা মানতে পারছে না।
গ্রোসারি ও মহল্লার কনভিনিয়্যান্ট স্টোরগুলো একেবারে মানছে না। জরিমানা ও শাস্তির বিধান রাখার পরও তারা সেগুলোর তোয়াক্কা করছে না। কোথাও কোথাও একটু সুপরিসর জায়গাজুড়ে দোকানগুলোর বাইরের চেহারা একটু ভিন্ন (লোকজন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে, আবার লাইনে থেকেও আত্মীয় বন্ধুত্ব ঠিক রাখতে কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, মুখের মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে গল্পে মশগুল থাকে), কিন্তু ভেতরে জিনিস নেওয়ার, মাছ, মাংস বাছাই করে নিয়ে কাটাবার ব্যস্ততা, দাম দিয়ে আগে বেরোবার হুড়োহুড়ি চলছেই। এসব কথা, কাহিনি-কাব্য অন্ধকার ঘরবন্দী সেলুনের ক্ষুর, কাঁচি দেখবে কোত্থেকে? তবে ওই সাঁঝবেলায় একত্র হলে গোল হয়ে বসে গল্পকালে ইঁদুর, আরশোলারা তাদের আগের রাতের অভিজ্ঞতার বয়ান বলে। তারা মনোযোগ দিয়ে শোনে।
মানুষগুলোর অকাল, অপমৃত্যু তাদের অনেক সন্ধ্যাকে ব্যথাতুর ভারাক্রান্ত করে তোলে। তবে এটাও ঠিক অবরুদ্ধ দিন-রাত্রির এই সময়টাই যা তাদের একটুখানি ভালো-লাগা, আনন্দ-বিনোদনের সময়। বাদবাকি সময়ের বেশির ভাগটাই হয় ঘুম, ঘুমের চেষ্টা, নয় তো অসার হয়ে পড়ে থাকা। তবে পুবদিকের লাগোয়া গ্রোসারি আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে বোঝা যায় খদ্দরদের নিজেদের ও দোকানের লোকেদের মধ্যে কথাবার্তায়। তারা উৎকর্ণ হয়ে শোনে। সাধারণত কথাগুলো হয় এমন—
‘ভাই, কালিজিরা আছে?’ কেউ জানতে চায়, ‘অরগানিক জিনজার, গার্লিক হবে?’ কর্মচারী কমবয়সী, ধৈর্য কম। সে অবজ্ঞার সঙ্গে অকারণ উত্তেজিত স্বরে বলে, ‘আমেরিকান অরগানিক সুপার স্টোরে যান।’ মুখ অন্যদিক ফিরিয়ে নিজেকে শুনিয়ে বলে, “ভারী আমার অরগানিক খানেওয়ালা?’
‘মাটির দাগ লাগা আদা-রসুন খেয়ে জীবন গেছে, এখন প্যান্ডেমিক টাকা পেয়ে অরগানিক জিনজার, গার্লিক খোঁজে?’ আগে ফ্রোজেন বড় রুই, কাতলা, মৃগেল, আইড়, বোয়াল চাইলে নিজেরাই এসে বেছে দিয়ে বলত, ‘এটা নেন। ভালো হবে।’ ইলিশ হাতে ধরে বলত, ‘নিয়ে যান, চাঁদপুরের ইলিশ। খেয়ে বলবেন।’ এখন ভেতর থেকেই খেঁকিয়ে বলে, ‘ওখানে আছে, সব ভালো, নিয়ে আসেন।’ কাটার সময় কোনো কোনো কাস্টমার বলে বসেন, ‘ভাই, আপনার হাতের গ্লাভস চেঞ্জ করে নেন। জায়গাটা, ব্লেডটা একটু পরিষ্কার করে নেবেন?’ মিট কাটার মনঃক্ষুণ্ন হন; কখনো-বা রেগে যান।
রাতে ভিড় থাকে না। মালিক, কর্মচারীদের ফিসফাস শোনা যায়। মালিক বলে, ‘হোন, আমরা যে সরকার থাইক্যা টাকা পাইছি, এইডা য্যান কেউ না জানে। জানলে লোকসানের কথা কইয়া জিনিসের দাম বেশি লওনের রাস্তা বন্ধ হইব। সবতে গন্ডগোল পাকাইব। আর হোন, আগের জিনিসগুলান য্যান পইড়া না থাকে, সবতে সাজাইয়া সামনে দিবি, বিক্রি করবি।’ দোকানের কর্মচারীরা তাদের নিরাপত্তার কথা বললে খেঁকিয়ে ওঠে, ‘আরে ব্যাডা এত ডরাস ক্যা, আল্লাহ্ কপালে মউত লেখলে কেউ ঠেকাইতে পারব? আরে কিসস্যু হইব না। আর অহন তো করোনা নাইক্যা।’ কর্মচারীদের মধ্যে মুরুব্বি রইছ চাচা আমতা-আমতা করে বলেন, ‘কাস্টমার ওগুরে একটু মাতিও রে বা, তাইনরা যাইন ছয় ফুট মাইন্যা চলুইন।’ মালিক ক্ষেপে যায়, ‘ওই চাচা, ব্যবছা বোঝেন? তিন মাসে লস দিছি কত, হিছাব কইরা কইতে পারবেন? কাস্টমার লক্ষ্মী, আর দোকান কি এই একটাই নি?’ এরপর সবাই চুপ হয়ে যায়।
এসব নিয়ে তারা প্রতিদিন আলোচনা করে। যেসব আঞ্চলিক কথা বুঝতে পারে না, ইঁদুরেরা বুঝিয়ে দেয়। ইঁদুরেরা চারদিক ঘোরে, সব জায়গায় যায়, অন্য দোকানপাটের ইঁদুরদের সঙ্গে মেশে। তারা নানান ভাষা বোঝে, বলতে পারে। পাশের মসজিদে নামাজি আসে। নামাজ পড়ে। বৈঠক করে, কেমন করে মসজিদের মুসল্লিদের মসজিদে ফিরিয়ে আনা যাবে। মুসল্লি না বাড়লে তো ইমাম, মুয়াজ্জিনের বেতন, অন্যান্য খরচ চালানো যাচ্ছে না!
মসজিদের উল্টোদিকে দক্ষিণে প্রেস রাতদিন জেগে থাকত। কত মানুষ আসত! কবি-সাহিত্যিকরাও আসতেন তাঁদের লেখালেখির নানা কাজ নিয়ে। আড্ডা হতো। চায়ের পর চা। আহা কী গমগমে দিন-রাত! সব বন্ধ। তার গা-ঘেঁষা ফোনের দোকান, সঙ্গে কম্পিউটার সারাই। লকডাউন চলাকালেও গোপনে খুলত; মানুষ আসত। খুব ব্যস্ত। লকডাউনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু ফোন। সব সময়, রাত দিন হাতের স্মার্ট ফোন জাগিয়ে রেখেছে, পাগল হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে যন্ত্রটি। তা ছাড়া আরেক শ্রেণির মানুষ তো ওই ফোন কিংবা ল্যাপটপেই তাঁদের সব মেধা, প্রতিভা ঢেলে দিচ্ছেন দিন-রাত। নতুন আমদানি ভার্চ্যুয়াল শোয়ের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল প্রতিভা প্রদর্শনী। এই সব নিয়েই চলছে করোনাক্রান্তির দিনকাল।
বাসায় এই চুল কাটাবিষয়ক কথা শুনতে শুনতে বিষয়টি এখন ঝগড়ার দিকে টার্ন নেবে বুঝতে পেরে দিন চারেক আগে ইঁদুরের ভাষা বোঝে (সে জার্মানির এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোশিপে ইঁদুর ও সমজাতীয় কতক প্রাণীদের ভাষা বিষয়ক দু বছরের কী একটা ডিপ্লোমা করে এসেছে)আমার এমন এক বন্ধুকে পাঠিয়েছিলাম উল্লিখিত সেলুনে। সে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ সময়ে গোপনে গিয়ে কলাপসিবলের পাশে দাঁড়িয়ে শুনে এসেছে, ওদের সেদিনের সান্ধ্য অধিবেশনে আলোচনা, যেখানে দোকান খোলার বিষয়ে মালিকের সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল। মালিক নাকি বলেছে, ‘এখন দোকান খুলে লাভ হবে না। কারণ, এই পেশায় লোকজনকে বারবার সাহেবের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসতেই হবে। দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। তা ছাড়া চুল কাটতে গেলে যার চুল কাটা হবে, তার মুখে মাস্ক থাকলে চুল কাটা সম্ভব নয়। সুতরাং তাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।’ বন্ধুটি আমাকে বলার সময় এটিও বলেছিল যে, মালিকের এই সিদ্ধান্তে নাকি তারা মোটেই বিমর্ষ নয়। উল্টো ইঁদুরেরা অনেক আগে সংগ্রহ করা পুরোনো ওয়াইন দিয়ে সেলিব্রেট করেছে।
বিষয়টি সবিস্তারে গিন্নিকে বললে তিনি পরামর্শ দেন, বাসায় ট্রিমার আছে, বাইরে থেকে চুল কাটার একটা কাঁচি কিনে আনলে বাকিটা তাঁরা দেখবেন। অর্থাৎ মা-মেয়েতে মিলে আমার চুল বাসাতেই কাটা হবে। নিজের চুলের প্রতি আমার বড় মায়া। মাথাভরা ঝাঁকড়া চুলের বেশির ভাগই ‘বাই’ বলে চলে গেলেও ক’গাছি যা এখনো আছে, তার অসম্মান আমি হতে দেব না। তারই ফলে আজ আমি ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কোন ফাঁকে গিন্নির হাতের স্মার্ট ফোন কর্মটি সেরে ফেলে। আমার উদ্ধত, উড়ন্ত, শোকের পতাকাবাহী (কবি শহীদ কাদরী থেকে ধার করলাম, না বলে, অনুমতি না নিয়েই) ওই ক’গাছি চুলের চেহারা আমাকে বিব্রত করল। তা ছাড়া সেলুনে চুল কাটাতে আরও কত মাস অপেক্ষা করতে হবে জানা নেই। ভেবে সিদ্ধান্তে নিই, লেখাটা শেষ করেই চুল কাটার কাঁচি কিনতে বাইরে যাব। কর্তন সম্ভাব্য চুলগুলোর জন্য মনটা কেমন করছে আমার!