ময়লা পরিষ্কার করে জীবন বদলে গেল কিশোরের

আন্তোনিও গিয়্যান। ছবি: আন্তোনিওর ফেসবুক থেকে নেওয়া
আন্তোনিও গিয়্যান। ছবি: আন্তোনিওর ফেসবুক থেকে নেওয়া

পুলিশি নির্যাতনে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে আমেরিকাজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। নিউইয়র্কের বাফেলো নগরীতে এমনই একটি মিছিলে যোগ দিয়েছিল মা-বাবাহীন আন্তোনিও গিয়্যান নামের এক কিশোর। মিছিলে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই একটু ঘুমানোর জন্য বাসায় গিয়েছিল। কিন্তু ঘুমটা আর দিতে পারেনি। বিছানায় যাওয়ার আগে ইউটিউবে দেশজুড়ে বিক্ষোভের ভিডিওগুলো একবার চোখ বুলিয়ে নিতে চেয়েছিল সে। এই ভিডিও দেখেই ঘুম তো আর হয়নি, জীবনটাও বদলে যাওয়ার পথ পেয়ে গেছে আন্তোনিও।

হাইস্কুলপড়ুয়া আন্তোনিও ভিডিও দেখে থমকে গেছে। যে শান্তিপূর্ণ মিছিলে সে যোগ দিয়েছিল, ফিরে আসার পর দেখে, সেই মিছিলেই সহিংস ঘটনা ঘটেছে। গত ৩০ মে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বাফেলোতে মার্কিন সেনাসদস্যদের সংঘর্ষ হয়েছে। অনেক বিক্ষোভকারী রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছেন। ডাউনটাউনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অনেক ভবনে ভাঙচুর হয়েছে। সড়ক নোংরা হয়ে আছে। সড়কে স্বাভাবিকভাবে হাঁটার মতো অবস্থা নেই। এসব দেখে আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি আন্তোনিও। চট করে বিছানা থেকে উঠে ছুটে গেছে ওই সড়কে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত দুইটা বাজে। কাউকে কিছু না বলে একা একাই নেমে পড়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে। কারণ, পরদিন যেন বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে পারেন। টানা ১০ ঘণ্টা ধরে কাজ করে রাস্তা পরিষ্কার করে ফেলে আন্তোনিও। তার এই মহৎ ভাবনার জন্য নিজের কমিউনিটি থেকে ‘ধন্যবাদ’ হিসেবে পাচ্ছে গাড়ি ও অর্থ এবং নামী কলেজের স্কলারশিপ। এতে যারপরনাই আনন্দিত আন্তোনিও। ওয়াশিংটন পোস্ট, গুডনিউজ নেটওয়ার্কসহ অনেক গণমাধ্যম আন্তোনিও গিয়্যানের এ ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরদিন সকালে বাফেলোর বেইলি অ্যাভিনিউয়ে রাস্তা পরিষ্কারের লোকজন বিস্মিত হয়ে যান। কারণ, আন্তোনিও একাই প্রায় পুরো রাস্তা পরিষ্কার করে ফেলেছে।

রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করে বিনে ফেলছে আন্তোনিও গিয়্যান। ছবি: আন্তোনিওর ফেসবুক থেকে নেওয়া
রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করে বিনে ফেলছে আন্তোনিও গিয়্যান। ছবি: আন্তোনিওর ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ঘটনার পর ম্যাট নামের একজন জানতে পারেন, আন্তোনিওর কোনো গাড়ি নেই। তাই তিনি খুশি হয়ে নিজের ব্যবহার করা ২০০৪ সালের ফোর্ড মুস্তাং মডেলের একটি গাড়ি তাকে উপহার দেন। এই গাড়ি পেয়ে অনেক খুশি আন্তোনিও। কারণ, আন্তোনিওর মা ২০১৮ সালে মারা যান। তিনি এই একই মডেলের একটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। এবার এমন গাড়ি উপহার পেয়ে মায়ের স্মৃতি মনে হয়েছে আন্তোনিওর। শুধু গাড়ি নয়, আরেকজন অর্থ দিয়েছেন। অনেকেই আবার ‘গো ফান্ড মি’ অ্যাকাউন্ট করে তার জন্য ৫ হাজার ৮০০ ডলার সংগ্রহ করেছেন। স্থানীয় একটি ইনস্যুরেন্স এজেন্ট আন্তোনিওর পুরো বছরের ইনস্যুরেন্সের অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আন্তোনিও জানিয়েছে, সে এত কিছু ভাবেনি। সে শুধু ভেবেছে, সকালে হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করতে আসবেন। তার আগেই পুরো রাস্তা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। তা না হলে বিক্ষোভকারীদের অনেক কষ্ট হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সড়কের প্রায় ১৭টি ব্লক সে পরিষ্কার করে ফেলেছে। কাচের টুকরাসহ ময়লা প্রায় বড় বড় ২৪টি ব্যাগে সে ভরে ফেলেছে। এ ঘটনার দৃশ্য দেখে তার আশপাশের লোকজন বিষয়টি ফেসবুকে শেয়ার করলে, তা ভাইরাল হয়ে যায়। আর এতেই বিষয়টি সবাই জেনে যায় এবং তাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন লোকজন।

আন্তোনিও জানায়, ‘বাসায় ফিরে ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার ফেসবুকে অসংখ্য টেক্সট এসেছে। অনেকে আমার ছবিসহ পোস্টে আমাকে ট্যাগ করেছে। ঘুম থেকে উঠে এটা আমার জন্য ছিল অনেক বড় বিস্ময়ের ঘটনা।’

এক সপ্তাহ আগে আন্তোনিও ভেবেছিল, সে ট্রেড স্কুলে ভর্তি হবে। এতে কিছু অর্থ বাঁচবে। সেই অর্থ দিয়ে পড়ে কলেজে ভর্তি হবে। কিন্তু তার এই মহৎ কাজের খবর স্থানীয় গণমাধ্যমে জেনে মেডেইলি কলেজ তাকে সেখানে পড়াশোনার জন্য পুরো স্কলারশিপ দিয়েছে। এ ঘটনা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে আন্তোনিও। সে বলেছে, ‘এ খবর শুনে আমি থমকে গেছি। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিলাম না।’ শুধু তা–ই নয়, তার চাচি ও চাচাতো ভাইবোনেরাও কেঁদে ফেলেছে।

বিক্ষোভকারীদের জন্য ১০ ঘণ্টা কাজ করে ১৭টি ব্লকের ময়লা ২৪টি বিনে ফেলেছে আন্তোনিও গিয়্যান। ছবি: আন্তোনিওর ফেসবুক থেকে নেওয়া
বিক্ষোভকারীদের জন্য ১০ ঘণ্টা কাজ করে ১৭টি ব্লকের ময়লা ২৪টি বিনে ফেলেছে আন্তোনিও গিয়্যান। ছবি: আন্তোনিওর ফেসবুক থেকে নেওয়া

মেডেইলি কলেজের প্রেসিডেন্ট কেন ম্যাকার বলেন, ‘আমাদের কলেজের গাইডলাইনে কমিউনিটি, ইন্টিগ্রিটি, কৌতূহল ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা আছে। একটি কাজ করে এই চার শর্তই পূরণ করতে পেরেছে আন্তোনিও। তাকে এখানে পড়ার সুযোগ দিয়ে আমরা সম্মানিত বোধ করছি।’

স্থানীয় একটি চার্চের প্যাস্টর ডুয়ানে থমাস বলেন, দুই বছর আগে মা মারা যাওয়ার পর আন্তোনিওর ছোট বেন আলিয়াহ তার নানির সঙ্গে থাকত। তাদের বাবা আলাদা থাকেন। সে সময় থমাস বাড়ির থালাবাসন মাজার কাজ করার শর্তে দুই ভাই-বোনকে বাসায় রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা আসেনি। আন্তোনিও তার চাচির বাসায় থাকত। কিছুদিন আগে চাচির বাসা ছেড়ে সে একটি ঘর ভাড়া করেছে। সেখানেই এখন সে ছোট বোনকে নিয়ে থাকে। পরিকল্পনা করছিল, একটি ছোট চাকরি জোগাড় করে সংসার ও পড়াশোনা চালিয়ে যাবে।