আমেরিকার পুলিশ বেশি মারমুখী
আমেরিকার রাজপথ এখনো উত্তাল জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে। গত ২৫ মে পুলিশের নির্যাতনে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যুর পর থেকেই উত্তাল আমেরিকা। এই বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুধু একজন জর্জ ফ্লয়েডের কারণে হচ্ছে না। আমেরিকায় পুলিশ হেফাজতে বিশেষত অশ্বেতাঙ্গদের মৃত্যুর হারই এমন বিক্ষোভের কারণ। আর এই বিক্ষোভই এ সম্পর্কিত নানা তথ্যকে সামনে নিয়ে আসছে। এমন নানা তথ্যের মধ্যে যে তথ্যটি সবাইকে নতুন করে ঝাঁকুনি দিচ্ছে তা হলো—ধনী ও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকাতেই সবচেয়ে বেশি লোক পুলিশ হেফাজতে বা পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য সন্নিবেশিত করে ওয়াশিংটন পোস্ট যে তথ্য জানাচ্ছে, তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। মার্কিন এই পত্রিকা জানাচ্ছে, ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমেরিকায় শুধু পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে ৫ হাজার ৪০০ মানুষ। এর মধ্যে ২০১৫ সালে পুলিশের গুলিতে মারা যায় ৯৯৪ জন। এর পরের দু বছরে মারা যায় যথাক্রমে ৯৬২ ও ৯৮৬ জন। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মারা যায় যথাক্রমে ৯৯১ ও ১ হাজার চারজন। আর চলতি বছরের ৭ জুন পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে আমেরিকায় মারা গেছে ৪৬৩ জন।
সন্দেহ নেই, পুলিশ হেফাজতের বা নির্যাতনে হওয়া মৃত্যুর সংখ্যা যোগ করলে এ সংখ্যা চমকে দিতে বাধ্য। কিন্তু এই পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব নয়। শুধু বলে রাখা ভালো, চলতি বছরের যে হিসাব ওয়াশিংটন পোস্ট দিচ্ছে, তাতে কিন্তু জর্জ ফ্লয়েড অন্তর্ভুক্ত নন। কারণ, তিনি গুলিতে মারা যাননি। তাঁকে ঘাড়ে হাঁটু চাপা দিয়ে মারা হয়েছে।
এই যখন অবস্থা, তখন আমেরিকাজুড়ে যে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছে, তা পুলিশ প্রশাসন সংস্কার এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি ভেঙে দেওয়া বা এর অর্থায়ন বন্ধের দাবিতে রূপ নেওয়াটা স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। কারণ, মানুষের করের অর্থে পরিচালিত এই বিভাগের তো মানুষের প্রাণ রক্ষায় কাজ করার কথা। কিন্তু তা না করে, তারা মানুষের প্রাণ নিচ্ছে।
আমেরিকার চলমান নাগরিক আন্দোলনে ‘ডিফান্ডিং পুলিশ’ স্লোগানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রাজ্য ও নগর পর্যায়ে পুলিশি ব্যবস্থাপনার পেছনে ব্যয় করা বাজেট কর্তনের দাবি উঠেছে সর্বত্র। বিরোধী হলেও এই এক দাবির কাছে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্রেটিক পার্টির সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন এক হয়ে গেছেন। দুজনই পুলিশের বাজেট কর্তনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
৮ জুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, পুলিশ ডিফান্ডিং বা পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হবে না। তিনি মূলত শক্তিশালী ও উচ্চ বেতনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চান। হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত পুলিশপ্রধানদের এক সভায় তিনি ৯৯ শতাংশ পুলিশ অফিসার মহৎ এবং পুলিশের কারণে জীবনযাত্রা শান্তিপূর্ণ আছে বলে উল্লেখ করেন।
তবে বাইডেন নিয়েছেন সতর্ক রাস্তা। ৮ জুন এ-সংক্রান্ত এক বিবৃতিতে মুখপাত্র অ্যান্ড্রু বেটসের মাধ্যমে বাইডেন বলেছেন, তিনিও পুলিশ ডিফান্ডিংয়ের বিপক্ষে। তবে তিনি পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন। পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক খাতেও জো বাইডেন পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের পক্ষে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
অন্য দেশগুলোর তুলনায় মার্কিন পুলিশ কতটা নির্দয় তা বোঝা যাবে সম্প্রতি প্রকাশিত সিএনএনের প্রতিবেদন থেকে। এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে সিএনএন আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার তুলনামূলক তথ্য বিশ্লেষণ করে জানায়, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে এ তিন দেশে পুলিশ হেফাজতে বা পুলিশের গুলিতে মৃত্যু বিবেচনায় সবার ওপরে রয়েছে আমেরিকা। ওই সময়ে যুক্তরাজ্যে এমন মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। অস্ট্রেলিয়ায় এ সংখ্যা ২১ জন। আর আমেরিকায় এ সংখ্যা ১ হাজার ৩৪৮। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে প্রতি লাখে মৃত্যুর দিক থেকেও সবার ওপরে আমেরিকা। প্রতি লাখে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় এমন মৃত্যুর সংখ্যা ২ ও ৫ জন হলেও আমেরিকায় এ সংখ্যা ১২ জন। মাসের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে ১৩৫ জন বা দিনে চারজন পুলিশের হাতে মারা যাচ্ছে। আর মার্কিন ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিসটিকসের দেওয়া পরিসংখ্যানেই কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা দৃষ্টিকটুভাবে বেশি।
প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে কত লোক গ্রেপ্তার হচ্ছে, পুলিশের নির্যাতনে বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া এক কথায় অসম্ভব। আমেরিকার ক্ষেত্রেও এমনকি এ তথ্য পাওয়া যায় না। বিশেষত পুলিশের হাতে দেশটিতে প্রতি বছর কত লোক মারা পড়ছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই।
এ বিষয়ে ২০১৫ সালে আমেরিকার হাউস জুডিশিয়ারি কমিটির সামনে দেওয়া বক্তব্যে এফবিআইয়ের সাবেক পরিচালক জেমস কোমি বলেছিলেন, ‘এ নিয়ে আমাদের পক্ষে আলোচনা করাটা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের হাতে কোনো তথ্য নেই। গত সপ্তাহান্তে কত লোক সিনেমা দেখতে গেছে, তার পরিসংখ্যানও এমনকি আছে। অথচ গত সপ্তাহে, গত মাসে, গত বছর বা এমন যেকোনো সময়কালে কত লোক পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।’
এফবিআইয়ের এক তথ্যে দেখা যাচ্ছ, ২০১৮ সালে মার্কিন পুলিশ ৪০৭ জনের ওপর গুলি চালিয়েছে। এর প্রতিটিই কিন্তু চালানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এফবিআইয়ের এই পরিসংখ্যানও পূর্ণাঙ্গ নয়। কারণ, একই বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের গুলিতে আরও বেশি মানুষের নিহতের খবর খোদ মার্কিন সংবাদমাধ্যমের কাছেই আছে, যার উল্লেখ শুরুতেই করা হয়েছে।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানাচ্ছে, ২০১৯ সাল আমেরিকায় ১ হাজার চারজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। আর এ বিষয়ে কাজ করা সংগঠন ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স জানাচ্ছে, এ সংখ্যা ১ হাজার ৯৯। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের দেওয়া তথ্য যে সত্য নয়, তা তো এফবিআইয়ের সাবেক পরিচালকের হাউস কমিটির সামনে দেওয়া বক্তব্যেই পরিষ্কার।
অথচ যুক্তরাজ্য (নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম) ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশে পুলিশ এমনকি সব সময় আগ্নেয়াস্ত্রও বহন করে না। জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কানাডার অভিমুখ বরং অনেকটা আমেরিকার মতো। তারপরও সেখানে ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ৪৬১টি। এ সংখ্যা অবশ্য সরকারি হিসাব মোতাবেক।
গ্রেপ্তারের সংখ্যার দিক থেকেও আমেরিকার ধারে–কাছে নেই উন্নত বিশ্বের বাকি দেশগুলো। সিএনএন জানাচ্ছে, ২০১৮ সালে দেশটিতে মোট গ্রেপ্তারে সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৬০টি। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ৩২ মার্কিন নাগরিকের একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। আর এই গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে এমন ব্যক্তির মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গরাই এগিয়ে।
আর ২০১৬ সালে আমেরিকান জার্নাল অব হেলথে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধের তথ্য বলছে, আমেরিকায় পুলিশের তৎপরতার কারণে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের নিহত হওয়ার ঝুঁকি তিনগুণ বেশি।
লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড প্রিজন ব্রিফের দেওয়া তথ্যমতে, কয়েদি সংখ্যার দিক থেকেও আমেরিকা সবার ওপরে। দেশটির জেলখানাগুলোয় ২০ লাখের বেশি কয়েদি রয়েছে, যা ওয়াশিংটন ডিসি, মায়ামি ও বোস্টনের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এই কয়েদিদের এক-তৃতীয়াংশই কৃষ্ণাঙ্গ। অথচ দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশের কিছু বেশি অংশ কৃষ্ণাঙ্গ। এ নিয়ে কিছুদিন পরপরই আমেরিকার বিভিন্ন শহর ও রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ ওঠে, যার অনেকগুলোই প্রকারান্তরে তারা স্বীকার করে নেয় বা নিচ্ছে।
গত বছরই যেমন নিউইয়র্ক পুলিশের বিরুদ্ধেও অনুরূপ তদন্ত হয়েছে এবং এর সত্যতাও পাওয়া গেছে। এবার আবার জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিষয়টি সামনে এসেছে। এখন আমেরিকা যে আন্দোলন দেখছে, তা তাই শুধু একজন জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর কারণেই নয়। ভাষাতাত্ত্বিক ও দার্শনিক নোয়াম চমস্কি তাই যথার্থই বলেছেন, এই বিক্ষোভ সাময়িক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং ৪০০ বছর ধরে চলতে থাকা আমেরিকান সমাজ ও রাষ্ট্রের বর্ণবাদী আচরণের প্রতিবাদ।