নিউইয়র্কে করোনায় মৃত্যুহীন প্রথম দিন
কিসের কারফিউ? জনতার বাঁধভাঙা প্রতিবাদে কারফিউর নতুন সংজ্ঞা খুঁজতে হচ্ছে এখন ক্ষুব্ধ আমেরিকার উত্তাল নগরীগুলোতে। দিনভর শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ শেষে কারফিউর নির্দেশ অমান্য করে নিউইয়র্কে মিছিল চলছে। কারফিউ অমান্য ও উশৃঙ্খল আচরণ দমনে ম্যানহাটনে ৯টার পর থেকে গণগ্রেপ্তার চলছে। পুলিশ কারফিউ বলবৎ করার চেষ্টা করছে। স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এনওয়াইপিডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি গ্রেপ্তারের সংখ্যা জানাতে পারেননি। বলেছেন, ডজন ডজন লোক গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক নগরীর স্বাস্থ্য বিভাগ আগের ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে কোনো মৃত্যু হয়নি বলে জানিয়েছে। মার্চ মাসের পর এই প্রথম নগরীতে একদিন করোনাভাইরাসে মৃত্যুহীন কাটল। শুধুমাত্র নিউইয়র্ক নগরীতেই ২১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে। করোনাভাইরাসে বিপন্ন অবস্থা থেকে নিউইয়র্ক ধাপে ধাপে খুলে দেওয়া হচ্ছে ৮ জুন থেকে। এ নিয়ে প্রস্তুতি চলছে। তবে গত এক সপ্তাহ থেকে ছড়িয়ে পড়া ব্যাপক বিক্ষোভের কারণে করনাভাইরাসের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বিক্ষোভে যোগ দেওয়া লোকজনের অধিকাংশই মাস্ক পরে থাকলেও এবং শারীরিক দূরত্ব যতটা সম্ভব মানা হলেও এ বিক্ষোভ সমাবেশগুলোর প্রভাব বুঝতে দু সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
জর্জ ফ্লয়েড নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকানের আটকে পড়া নিঃশ্বাস এখন বিস্ফারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আটকে পড়া দমে দম নিচ্ছে আমেরিকার সংবেদনশীল মানুষেরা। টানা অষ্টম দিনের মতো নিউইয়র্কসহ আমেরিকার সর্বত্র উত্তাল আন্দোলনে সর্ব বর্ণের মানুষ কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আবারও উচ্চারণ করেছে, 'আমরা বিচার চাই।' ব্রুকলিনে জর্জ ফ্লয়েডের স্মরণসভায় দাঁড়িয়ে নাগরিক আন্দোলনের নেতারা রাজধানী ওয়াশিংটন অভিমুখে যাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
২৮ আগস্টকে সামনে রেখে সমস্ত আমেরিকা থেকে নাগরিক আন্দোলনের লোকজন ওয়াশিংটন অভিমুখে যাত্রা করবেন। এ যাত্রায় জর্জ ফ্লয়েডসহ পুলিশের হাতে নিহত মানুষের স্বজনরা নেতৃত্ব দেবেন। মার্টিন লুথার কিং যেখানে দাঁড়িয়ে ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট তাঁর ঐতিহাসিক 'আই হ্যাভ আ ড্রিম' বক্তৃতাটি করেছিলেন, সেখানে আবার দাঁড়াবেন আমেরিকার বঞ্চিত মানুষজন। ঘোষণা করবেন নতুন দিনের ইশতেহার।
জর্জ ফ্লয়েডকে স্মরণ করার জন্য মিনিয়াপোলিস থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত স্মরণসভা হচ্ছে। ফুলে ফুলে ভরে ওঠা কাস্কেট (শববাহী বাক্স) সামনে রেখে জর্জের স্বজনেরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। বক্তৃতা করছেন নাগরিক আন্দোলনের নেতারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার ব্রুকলিনের স্মরণসভায় দাঁড়িয়ে ওয়াশিংটন ডিসি অভিমুখে পদযাত্রার ঘোষণা করেন নাগরিক আন্দোলনের নেতা আল শার্পটন। তিনি বলেন, '২৮ আগস্ট আমরা যাব ওয়াশিংটনের লিংকন মূর্তির ছায়াতলে। সেখানে দাঁড়াব, যেখানে মার্টিন লুথার কিং দাঁড়িয়েছিলেন। সাদা, কালো, হিস্পানিক, আরব—সবাই দাঁড়িয়ে আমরা আবারও লুথার কিংয়ের স্বপ্নের পুনঃপ্রতিশ্রুতি ঘোষণা করব।'
আল শার্পটন বলেন, '২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন যাত্রার মধ্য দিয়ে আমরা আগামী ভোটের জন্য প্রস্তুত হব। কেবল হোয়াইট হাউস দখলের ভোট নয়, প্রতিটি স্থানীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচনে পরিবর্তন আনার জন্য আমরা শপথ নেব।' হাজারো ক্ষুব্ধ জনতার সামনে চলমান সময়ের জনপ্রিয় কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক আন্দোলনের নেতা আল শার্পটন ঘোষণা দেন, 'আমরা সময়কে বদলে দেবো।'
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাইবেল হাতে নিয়ে ছবি তোলার সমালোচনা করে আল শার্পটন বলেন, 'কেউ একজন বাইবেল হাতে নিয়ে ছবি দিয়েছেন।' বালক বয়স থেকে নিজে বাইবেল পাঠ করার কথা উল্লেখ শার্পটন বলেন, 'এমন করে কেউ বাইবেল হাতে ধরে না। আমরা বাইবেলকে এমন করে ব্যবহার করি না।'
আমেরিকার সমস্ত বড় বড় নগরী ছাড়াও প্রান্তিক নগরীগুলোতেও বিক্ষোভ সমাবেশ চলেছে। নিউইয়র্কসহ কিছু কিছু নগরীতে বিচ্ছিন্ন লুটপাটের ঘটনা ঘটলেও আন্দোলনকারীরা গত কয়েক দিনের টানা ঘটনায় অনেকটাই সচেতন। বিক্ষোভের মিছিল থেকে লুটপাটের বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভাকারীদের পুলিশ কোথাও বাধা দিচ্ছে না। সমাবেশ বিশৃঙ্খল হলেই পুলিশ এগিয়ে আসছে। ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে। গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে।
কোথাও কারও ডাকে নয়, মানুষ সমানে নেমে আসছে নিজেদের উদ্যোগে। যোগ দিচ্ছে দূরের কাছের সমাবেশগুলোতে। গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর নিউইয়র্কের আকাশ পরিচ্ছন্ন ছিল। ব্রুকলিন থেকে কুইন্সের সর্বত্র দেখা গেছে স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনকারীদের। থেমে থেমে স্লোগান উঠেছে। 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' , 'দিস ইজ হাউ ডেমোক্রেসি লুক লাইক'—এসব স্লোগান দিয়ে লোকজন বর্ণবৈষম্য ও সামজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করছে।
রাত ৮টা থেকে কারফিউ বলবৎ আছে নিউইয়র্ক নগরীতে। চেনা কারফিউ থেকে এর ধরন আলাদা। লোকজনের মিছিল চলছে। পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতিতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লোকজনের দ্রোহী মিছিল চলছে।
ব্রুকলিনে জর্জ ফ্লয়েডের স্মরণসভা শেষ হওয়ার পর হাজার হাজার মানুষ ব্রুকলিন ব্রিজ দিয়ে পদযাত্রা শুরু করে। নিউইয়র্কের সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোনো প্রতিবাদী মিছিলে এমন লোকের সমাবেশ দেখা যায়নি। ব্রুকলিন ব্রিজের মোড় থেকে আমাদের প্রতিনিধি সোহেল মাহমুদ জানান, সব বর্ণের লোকজনের উপস্থিতি ছিল এসব মিছিলে। শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা নিয়ে লোকজন মিছিল করছে। কেউ গানের তালে তালে স্লোগান ধরছে, কেউ হাতে লেখা পোস্টার ধরে নীরবেই হেঁটে যাচ্ছে। সবার দাবী একটাই, বৈষম্য আর বিদ্বেষের অবসান হোক। আমেরিকায় যাতে আর কোনো জর্জ ফ্লয়েডকে এমন করে মারা যেতে না হয়।
মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকানকে গত ২৫ মে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে নির্যাতন করেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওভিন। এতে সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড় ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়। এক প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণ করা ১০ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে চাওভিন ফেঁসে যান। সেখানে দেখা যায়, গলায় হাঁটু চেপে ধরায় ফ্লয়েড নিশ্বাস নিতে না পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার চাওভিনকে বলছেন, 'আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।' ভিডিওটি ভাইরাল হলে চাওভিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। মিনেসোটা থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো আমেরিকায়।