ফেক আইডি
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন আমি ঢাকায় একটা বায়িং অফিসে সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার হিসেবে চাকরি করি। যদিও আমি স্বাধীনভাবে নিজের বায়ার সরাসরি ডিল করলেও একজন ম্যানেজারের অধীনস্থ ছিলাম। তিনিই আমার বস, যিনি অহেতুক তদারকির নামে আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। বায়িং অফিসের মালিক, পরিচালক ও জিএম সাহেব আমার কাজে সন্তুষ্ট থাকলেও আমার বস সব সময় কিছু না কিছু অহেতুক ভুল ধরে আমার অধীনস্থ জুনিয়র কলিগদের সামনে অপদস্থ করে আমার ইজ্জত পাংচার করে দিতেন। এসব করে তিনি বেশ মজা পেতেন, আর দাঁত কেলিয়ে হাসতেন। আমিও ‘ইয়েস বস’ মুভির শাহরুখ খানের মতোই ‘ইয়েস বস’ বলে নীরবে সহ্য করে নিতাম। তবে মনের ভেতর জিদ চেপে যায়—তাঁকে যেভাবেই হোক জব্দ করতেই হবে। তাই তাঁর দুর্বলতা খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে একদিন পেয়েও গেলাম। তাঁর কেবিন রুমের পাশে ডেস্কে বসে এক জুনিয়র সহকর্মীর মাধ্যমে জানতে পারি, তিনি পরকীয়া প্রেমে মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত। যদিও তাঁর ঘরে সুন্দরী স্ত্রী ও দুই ছেলে সন্তান আছে। তবুও তিনি বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে ফেসবুকে চ্যাটিং করেন; ফোনে অন্তরঙ্গ কথা বলেন। আর মেয়েগুলো তাঁকে বোকা বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়।
এ তথ্য পাওয়ার পর আমার ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে একটা দুষ্ট ফন্দি বের করি। প্রথমে রাজি না হলেও বন্ধুদের একটাই কথা, ‘যেমন কুকুর, তাকে তেমন মুগুর দেওয়া উচিত।’ তাই ফন্দি মোতাবেক ফেসবুকে আমি মেয়ে সেজে একটি ফেক আইডি খুললাম, নাম নিলাম ‘ঐশী চৌধুরী’। আমার এক বন্ধুর সহযোগিতায় ভারতীয় এক সুন্দরীর কিছু ছবি সংগ্রহ করে সেগুলো একের পর এক আপলোড করলাম। আসল আর নকল যা-ই হোক, সুন্দরী মেয়েদের আইডিতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের অভাব হয় না। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় হাজারখানেক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এল। আমিও সবগুলো রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করলাম। ছবিগুলো প্রচুর লাইক ও কমেন্টসে ভরে গেল। এখন ফেক আইডিটাকেই রিয়েল মনে হচ্ছে। এবার সময় হলো আমার বসকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর। যেদিন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম, সেদিনই এক্সেপ্ট হলো। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সবগুলো ছবিতে লাইক দিলেন। আমি তো খুশিতে গদগদ, শিয়াল তাহলে টোপ গিলেছে। আমিও ওই ফেক আইডি থেকে তাঁর কিছু ছবিতে লাইক দিলাম। ব্যস কাজ হয়ে গেল। তিনি প্রতিদিন সকাল-বিকেল ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে রুটিনমাফিক ‘গুড মর্নিং’, ‘গুড আফটার নুন’ লিখে শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করলেন। আমিও ফেক আইডি থেকে তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে থাকলাম।
এভাবে সপ্তাহখানেক যাওয়ার পর তিনি ম্যাসেঞ্জারে ভালো বন্ধু হওয়ার আহ্বান জানালেন। আমিও সাড়া দিলাম। তখন থেকে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ব্যক্তিগত কথা লিখে ম্যাসেজ পাঠাতে শুরু করলেন। আমিও সমানতালে উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। সম্পর্কটা বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে। এবার তিনি সরাসরি কথা বলতে মোবাইল নম্বর চাইলেন। আমি পড়লাম মহাবিপদে। বন্ধুদের বুদ্ধিতে একটি নতুন সিম ও চায়না মোবাইল সেট কিনলাম, যা দিয়ে কণ্ঠ বদলে কথা বলা যায়। তারপর শুরু হলো কথা বলা। বস জানালেন, স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সেপারেশন চলছে। দুই ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী আলাদা থাকে। তিনি খুব নিঃসঙ্গ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তাঁর সব কথাই ছিল পুরোপুরি মিথ্যা। আমি সব কথাই রেকর্ড করে রাখতাম। ইনবক্সে ম্যাসেজগুলো তো রয়েছেই। কিছুদিন কথা বলার পর তিনি আসল রূপ প্রকাশ করলেন। কথায় ধীরে ধীরে ফিজিকস-কেমিস্ট্রি থেকে শুরু করে একদম বায়োলজি পর্যন্ত চলে গেলেন। আমার অস্বস্তি লাগলেও বেশ মজা পাচ্ছিলাম। এদিকে তিনি দেখা করতে অস্থির হয়ে গেলেন। এমনকি কোনো এক আবাসিক হোটেলে গোপন অভিসারে যাওয়ার প্রস্তাবও রাখলেন।
এমন অবস্থায় হঠাৎ করেই একদিন অফিস টাইমে আমি তাঁকে মেসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ের সবগুলো স্ক্রিনশট ও ভয়েস রেকর্ডগুলো পাঠালাম। সেই সঙ্গে পাঠালাম তাঁর স্ত্রীর মোবাইল নম্বরটাও। এও জানালাম, ‘আপনার কুকীর্তির সবকিছু আজকেই আপনার স্ত্রীর কাছে পাঠাব।’ তিনি এসব দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বারবার কল করতে লাগলেন। কিন্তু আমি পিক করছি না। আমি আমার ডেস্কে বসে তাঁর অবস্থা দেখে মজা পাচ্ছিলাম। তিনি তখন একের পর এক ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছেন।
বসের ম্যাসেজগুলো ছিল এমন—‘আমি তোমার পায়ে ধরি, আমার স্ত্রীর কাছে এসব দিয়ো না। সে এসব দেখলে আমার সংসার ভেঙে যাবে। আমাকে তখন আত্মহত্যা করতে হবে।’ আমি কিছু সময় পর তাঁর রুমে ঢুকে সালাম দিলাম। তিনি আমাকে দেখে খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘খুব জরুরি কিছু না হলে পরে আসেন।’ আমি বললাম, ‘বস, আমি জরুরি বিষয়ে কথা বলতেই এসেছি।’ তারপর চেয়ারে বসে তাঁকে জানালাম, ‘ঐশী চৌধুরী নামের আইডিটা আমার দূর সম্পর্কের খালাতো বোনের। সে আপনাদের দুজনের মধ্যে ঘটে যাওয়া সবকিছুই আমাকে বিস্তারিত বলেছে। এখন সে আপনার পরকীয়া প্রেমের সব কথা ভাবিকে জানাতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি খুব অনুরোধ করে ঐশীকে আটকে রেখেছি।’
আমার বসের তখন আমার পায়ে ধরার অবস্থা। আমার সঙ্গে সব খারাপ ব্যবহারের জন্য দু হাত জোড় করে মাফ চাইলেন। আর এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য সহযোগিতা চাইলেন। পাশাপাশি আল্লাহর কসম কেটে জানালেন, জীবনে আর এমন কাজ করবেন না। আমিও দয়ার শরীর, তাই সেই যাত্রায় তাঁকে মাফ করে দিলাম। এই ঘটনার পর সেখানে প্রায় ছয় মাস চাকরি করেছিলাম। তিনি সেই ছয় মাসে আমাকে নিয়ে একটিও বাজে মন্তব্য করেননি।