এ কোন ট্রাম্পকার্ড ট্রাম্পের?
ইরানি জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বড় ধরনের জুয়াই খেলে ফেললেন। অন্তত রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা তা-ই মনে করছেন।
দেড় বছর ধরে ইরানের সঙ্গে অলিখিত লড়াই চালিয়ে আসছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু এ লড়াইয়ে তিনি শেষ দেখতে পাচ্ছিলেন না। এমনকি জেতার কোনো উপায়ও তাঁর কাছে ছিল না। শেষমেশ তিনি শুরু করে দিলেন লড়াই। তিনি আঘাত হানলেন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের অভিজাত কুদস বাহিনীর কমান্ডার জেনারেলের ওপর। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন এই তথ্য জানিয়ে বলেছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশেই সোলায়মানিকে হত্যা করা হয়। আজ শুক্রবার বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে এ কথা জানানো হয়।
সোলাইমানিকে হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের কী লাভ হলো?
মার্কিন সংবাদ সংস্থা ‘পলিটিকো’ তাদের এক বিশ্লেষণে লিখেছে, ইরানের শীর্ষ সেনা কমান্ডারকে হত্যার মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এক শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করা হলো। একই সঙ্গে সৃষ্টি করা হলো মারাত্মক শত্রুতার একটি ক্ষেত্র, যা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও মিত্রদের ওপর বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য ও এর আশপাশের অঞ্চল এখন হয়ে উঠতে পারে রণক্ষেত্র। পাল্টা হামলা ও প্রতিশোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে কাশেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার জন্য মার্কিন হেলিকপ্টার হামলাকে দায়ী করেছে ইরান। তারা বলেছে, ইরাকি মিলিশিয়া নেতা আবু মাহদি আল-মুহানদিসও নিহত হয়েছেন। পেন্টাগনের বিবৃতিতে বলা হয়, বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের লোকজনকে রক্ষায় প্রেসিডেন্টের নির্দেশনায় কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছে মার্কিন সেনাবাহিনী। কেউ কেউ বলছেন, এ হামলায় মার্কিন ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। তবে পেন্টাগনের পক্ষ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি।
পেন্টাগন বলেছে, জেনারেল সোলাইমানি মার্কিন কূটনীতিক ও সদস্যদের ইরাকসহ ওই অঞ্চলে আক্রমণের জন্য সক্রিয়ভাবে পরিকল্পনা তৈরি করছিলেন। এ ছাড়া তিনি বাগদাদে মার্কিন সেনা এবং বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে সাম্প্রতিক হামলার জন্য দায়ী। ইরানের ভবিষ্যৎ আক্রমণ পরিকল্পনা নস্যাৎ করতেই এ হামলা চালানো হয়েছে।
ইরাকের মাটিতে সরাসরি সোলাইমানিকে লক্ষ্য করে হত্যার ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী নাড়া দিয়েছে। এর প্রভাব বিবেচনা করে তরতর করে বেড়ে গেছে তেলের দাম। মার্কিনরা দীর্ঘদিন ধরে সোলাইমানিকে সন্ত্রাসী মানসিকতার লোক বলে চিহ্নিত করে আসছে।
কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা, পাশাপাশি প্রবীণ ইরান-বিষয়ক পর্যবেক্ষকেরা বলেছেন, হত্যাকাণ্ড তাঁদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত পদক্ষেপ ছিল।
সোলাইমানি সম্পর্কে ধারণা রাখেন এবং ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড সম্পর্কে বই ‘ভ্যানগার্ড অব দ্য ইমাম’ বইয়ের লেখক আফসোন অসতোভার বলেন, ইরান এর প্রতিশোধ অবশ্যই নেবে। কোনো মতেই এর ছাড় দেবে না তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার কাছে এখনকার উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপ। এটাই কি একটি আঞ্চলিক সংঘাতের শুরু? আমাদের এখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’
আরেক সামরিক কর্মকর্তার মতে, ইরান এখন যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় তাদের গোপন কার্যক্রম শুরু করে দেবে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, গালফ—যেকোনো জায়গায় আক্রমণ হতে পারে।
সিআইএ ও মোশাদের হিটলিস্টে সর্বাগ্রে গুরুত্ব পাচ্ছিলেন জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। নিজ দেশে ভক্তদের কাছে যাঁর পরিচিতি হাজি কাশেম নামে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো সমরজগতের বিশেষ মনোযোগে ছিলেন তিনি। ইরানে দারুণ জনপ্রিয় জেনারেলের হত্যার বদলা ইরান কীভাবে নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে অনেক বেশি কর্মসূচি নিতে দেখা যায় ট্রাম্প ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে। ট্রাম্প একে বলছিলেন ‘সর্বোচ্চ চাপ’। এ চাপ দিতে গিয়ে ইরান ও তার মিত্রদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়াচ্ছিলেন বারবার। কিছুদিন আগেও মার্কিন এক ঠিকাদার ইরাকে নিহত হন। এর পেছনে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে আক্রমণের জন্যও মিলিশিয়াদের দায়ী করা হয়।
সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে পুরো ঘটনা এখন অন্যদিকে মোড় নিতে পারে। ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা ও সামরিক পদক্ষেপের হুমকিদাতা ট্রাম্পের জন্য এখন যুদ্ধে জড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ বছরের শুরুতেই তেলবাহী জাহাজে আক্রমণের ঘটনা নিয়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান পরস্পরের ড্রোন ভূপাতিত করার দাবিও করেছিল। ট্রাম্প তখন ইরানে সরাসরি আক্রমণের সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তে প্রত্যাহার করেন। ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সেনা পাঠালেও বারবার বলছেন, তিনি যুদ্ধে জড়াতে চান না। তবে ইরান এখন তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার জবাব দিতে বাধ্য হবে। যার প্রভাব এ বছরের মাঝামাঝি মার্কিন নির্বাচনেও পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট দল সোলাইমানিকে হত্যার বৈধতা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলেছে। তবে রিপাবলিকানরা একে বিজয় হিসেবে দেখছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট টুইটারে মার্কিন পতাকা প্রদর্শন করে সে ঘোষণাই দিচ্ছেন।
সিনেটর ক্রিস মারফি প্রশ্ন তুলেছেন, সোলাইমানি মার্কিন শত্রু ছিলেন, এতে সন্দেহ নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র কি শুধুই গুপ্তহত্যাকারী? কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে খুন করে আঞ্চলিক যুদ্ধ বাধানোর ঝুঁকি কি তৈরি হলো না? সোলাইমানিকে হত্যার বিরূপ প্রভাব ইরাক ও এর আশপাশের দেশে পড়বে। এসব দেশে ইরানের বন্ধু রয়েছে।
ইরানকে চাপের মুখে রাখায় ইসরায়েলের প্রশংসা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর বাইরে সৌদি, সংযুক্ত আরব আমিরাতও যুক্তরাষ্ট্রের পাশে আছে। সোলাইমানির হত্যায় তাদের কিছুটা মায়াকান্না দেখানো স্বাভাবিক হলেও ইরানের ক্ষোভ তাদের ঠেকানোর প্রস্তুতিও থাকতে হবে।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ২০১৮ সালের মে মাসে। ট্রাম্প সরকার ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করে। এ ছাড়া জাতিসংঘকে দিয়ে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে ঘোষণা দেওয়ানো হয়। এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা চলছিল। ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথা বললে ট্রাম্পের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর মিত্রদের বাইরে পারমাণবিক কর্মসূচি চালাতে গেলেই এখন ট্রাম্পের চক্ষুশূলে পরিণত হতে হচ্ছে। কথায় বলে—ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়।