মহান বিজয় দিবস ও এর পরবর্তী প্রেক্ষাপট যে মানুষটিকে উদ্বেলিত করেছিল, নিরন্ন মানুষের হাহাকার নতুন করে তাদের জন্য কিছু করার সাহস জুগিয়েছিল, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের অভিপ্রায় নিয়েই তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই সময়। গরিবের বাতিঘর হয়ে ওঠা সেই মানুষটি আর কেউ নন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তিনি আজ রোগশয্যায়। দেশে–বিদেশে তাঁর জন্য দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তিনি আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন—এটিই প্রার্থনা।
বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ফজলে হাসান আবেদের জন্ম। আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর কর্মের পরিধি বিস্তৃত করেছিলেন। একেবারে সমাজের নিম্নবিত্ত অসহায় মানুষের কল্যাণে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনকে সামনে রেখে বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ এলাকার শাল্লা গ্রামে তিনি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্র্যাকের জন্ম দিয়েছিলেন। সেই সময়ে কবি সুফিয়া কামালকে চেয়ারম্যান করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ফজলে হাসান ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা হলেও এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সিলেটের আরেক কৃতি পুরুষ ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী চৌধুরী গত ১ সেপ্টেম্বর মারা গেলেন।
জাতির চরম বিপদের দিনে একদিন জনকল্যাণকে সামনে রেখে এই দুই বন্ধু এক বিন্দুতে মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মহৎ কিছু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। আসলে ফজলে হাসান আবেদ শৈশবের শুরুতে দেখেছেন, সমাজের একেবারে নিম্নশ্রেণির মানুষকে নিয়ে তাঁর মমতাময়ী মায়ের কাজ কারবার। মূলত তাঁর সেই মা তার হৃদয়ের দুর্বল স্থানের এক বিশাল অংশজুড়ে ছিলেন।
ফজলে হাসান আবেদের বর্ণনা মতে, তাঁর মা কেবল গ্রামের দরিদ্র পরিবারের অন্নবস্ত্র আর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতেন না। একই সঙ্গে রাতের অন্ধকারে যে বাতি জ্বালাতে পারে না, তার জন্য কেরোসিন তেল পাঠাতেন। মূলত তাঁর মতে, ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার পেছনে শৈশবের সেই স্মৃতিটা একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। প্রাথমিক পড়াশোনা তাঁর জন্মস্থান হবিগঞ্জে শুরু হলেও পরে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ফিজিকসে ভর্তি হন। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন।
চার বছরের কোর্স দুই বছর পার হওয়ার পরে মনে হলো, তার এই পড়াশোনা দেশের কোনো কাজে আসবে না। এই শিক্ষার পেছনে সময় ব্যয় করার কোনো অর্থ হয় না। দুই বছরের মাথায় গেলেন লন্ডনে। ভর্তি হলেন কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ে। চার বছরের শিক্ষাবর্ষের পুরোটাই শেষ করলেন তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে। কিন্তু ওই সময়টায় বিপত্তি বাঁধল, তার মা মারা গেলেন। যেন এটি সহ্য করার মতো শক্তি ছিল না নিজের ভেতর। অনেকটা উদ্ভ্রান্তের মতো শুরু হলো তার পথ চলা। ইংল্যান্ড থেকে গেলেন কানাডায়। আমেরিকার নিউইয়র্কসহ পশ্চিমের নগরগুলোতে অনেকটা বোহিমিয়ান জীবনের মতো। শেষ পর্যন্ত ফেরত এলেন দেশে ১৯৬৮ সালে। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে দেশের আকাশ–বাতাস গরম হয়ে উঠেছে তখন। আর ওই সময়টাতে ফজলে হাসান আবেদ শেল ওয়েল কোম্পানিতে হেড অফ ফিন্যান্স হিসেবে যোগ দিলেন।
দুই বছরের মাথায় দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিল ঘূর্ণিঝড়। চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়াও নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল লন্ডভন্ড হলো। মারা গেলেন প্রায় তিন লাখ মানুষ। কিন্তু উপদ্রুত অঞ্চল নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কিছুই করল না। আন্তর্জাতিকভাবে এই কাজ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হলো। কিন্তু আইয়ুব খানের সরকার আগাগোড়াই নির্বিকার ভূমিকা পালন করল। আর এই সময়টাতেই ফজলে হাসান আবেদ তাঁর কিছু সহযোদ্ধা যেমন ব্যারিস্টার ইসলাম চৌধুরী, কায়সার জামানকে নিয়ে হেল্প নাম দিয়ে একটি সংগঠনের ব্যানারে দুর্গত চরাঞ্চলের মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেন। ঘূর্ণিদুর্গত অঞ্চলে আস্তে আস্তে বিদেশি সাহায্য আসা শুরু হলে তারা জার্মানির একটি সংস্থা থেকে তিন মিলিয়ন মার্ক অনুদান লাভ করেন। সে টাকা দিয়ে মনপুরা অঞ্চলের পুনর্গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন তাঁরা। শুরুটা এভাবেই হয়েছিল। তারপরের ইতিহাস দেশের রাজনীতির টালমাটাল অবস্থা।
পাকিস্তানের তৎকালীন সরকারের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করার ভেতর অশনিসংকেতের জন্ম। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট সামনে চলে এল। ফজলে হাসান আবেদ তখন শেল ওয়েল কোম্পানির লোভনীয় চাকরিকে উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, সেই কারণেই বিশ্ব জনমত গঠনের লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমালেন। তিনি ’৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী হেল্প নাম নিয়ে সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে দেশের মাটিতে কল্যাণমূলক কাজের সূচনা করেছিলেন লন্ডনে পৌঁছে। হেল্প নামের পেছনে বাংলাদেশ শব্দটা জুড়ে দিয়ে হেল্প বাংলাদেশের ব্যানারে নতুন উদ্যোগে কাজ শুরু করলেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে। তারপর সহযোদ্ধা আরও কয়েকজনকে নিয়ে ব্রিটিশ এমপিদের সঙ্গে দেখা করাসহ বিশ্ব জনমত গঠনের লক্ষ্যে লন্ডন থেকে প্যারিস, তারপর জাতিসংঘ পর্যন্ত বিরামহীন প্রচারণা অব্যাহত রাখলেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারের তহবিলে অনুদান দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন।
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় উপস্থিত হয়ে দেখা করলেন অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আরও কয়েকজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে। ওই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লন্ডনে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের অনুদান দেওয়া ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের কাজে ব্যবহারের জন্য অনেকগুলো দুরবিন এবং আসন্ন শীত মৌসুমের মোকাবিলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করলেন। তারা আর্থিক অনুদান সংগ্রহের স্মৃতিচারণের মুহূর্তে আবেদ বলেছিলেন, শুধু প্রবাসী বাঙালি সমাজ নয়, একজন ব্রিটিশ মহিলা এক পাউন্ডের একটি নোট পাঠিয়ে লিখেছিলেন, আগামী দুই মাস আমি আর ডিম খাব না। আমি তোমাদেরকে দিলাম ডিম কেনার আমার পয়সাটা। এভাবে অনেক অর্থ এসেছিল তাদের কাছে। ৯ মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের অবসান ঘটল ১৬ ডিসেম্বর।
১৭ জানুয়ারি ১৭ দেশে ফিরলেন ফজলে হাসান আবেদ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের ইচ্ছা নিয়ে কাজে যোগ দিলেন। কিন্তু এজন্য টাকা-পয়সা দরকার ছিল। তখন লন্ডনে তাঁর একটি ফ্ল্যাট বাড়ি ছিল, বিনা দ্বিধায় তা বিক্রি করে দিলেন ৬ হাজার ৮০০ পাউন্ড মূল্যে। তাঁর অন্যতম সহযোদ্ধা ব্যারিস্টার চৌধুরীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২৫ হাজার টাকা ছিল। ওই টাকাগুলো তারা একত্রিত করে বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ অঞ্চলের একটি গ্রামে প্রথম ব্র্যাক–এর ব্যানারে কাজ শুরু করলেন।
আজ সেই প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠান। এখন প্রায় এক লাখ পূর্ণকালীন কর্মী বাহিনী রয়েছে। এর মধ্যে আট হাজার কর্মী দেশের বাইরে কাজ করছেন। এই সংস্থার অধীনে রয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি ব্যাংক, একটি বীজ কোম্পানি, একটি মুরগির খামার, একটি ড্রাইভিং স্কুল এবং ২১টি ফ্যাশন বুটিকের একটি চেইন শপ। শুরুতে সুনামগঞ্জ অঞ্চলকে বেছে নেওয়ার কারণ ছিল, ওই অঞ্চলটা হিন্দু প্রধান অঞ্চল ছিল। এ কারণে পাকিস্তানি জান্তা সরকারের রোষানলে পড়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে এই গ্রামের মানুষ। তাই পুনর্গঠনের জন্য শাল্লা অঞ্চল বেছে নিয়েছিলেন তারা। একটি বিদেশি দাতা সংস্থা অক্সফাম প্রায় ২ লাখ পাউন্ড অনুদান দিয়েছিল তাদের।
বাংলাদেশের বাইরে আরও দশটি দেশের মানুষ ব্র্যাকের কর্মসূচির আওতায় উপকৃত। এসব খাতের জন্য বার্ষিক বাজেটের পরিমাণ ২৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। কিংবদন্তিতুল্য ইতিহাসের জন্ম দিয়ে গেলেন ফজলে হাসান আবেদ। তাঁর নিজস্ব বলতে কিছু নেই। তিনি যে বাড়িতে বাস করেন, সেটাও ব্র্যাকের। এ ধরনের এক মানুষকে নিশ্চয় মনে রাখবে এশিয়া ও আফ্রিকার প্রায় ১৫ কোটি মানুষ। আন্তর্জাতিক দুনিয়া তাঁর এসব জনকল্যাণমূলক কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর মূল্যায়ন সঠিক মাত্রায় হলেও নিজের দেশের মানুষের কাছে তিনি ততটা পরিচিতি পাননি। সুবিধাবাদী সমাজ তাঁকে সম্মান জানায়নি, কিন্তু কোনো বিনিময় ছাড়াই তিনি তার সব জনকল্যাণমূলক কাজ সমাধা করে সৃষ্টি করেছেন এক যুগান্তকারী ইতিহাস। সময়ের সীমা অতিক্রম করে দেশে–নিদেশে জ্যোতি ছড়িয়ে যাবে স্যার ফজলে হাসান আবেদের নিঃস্বার্থ অবদান।