২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

উদীচী আকাশ ছোঁয়ার অপেক্ষায়

প্রগতিশীল গণমুখী সংস্কৃতি বিভিন্ন সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে—এ কথা বলতে দ্বিধা নেই। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে ভারতীয় মুসলিমদের দেশজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দ্বিজাতি-তত্ত্বভিত্তিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা বাঙালি মুসলমানকে শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সেই চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াই। ৫২ থেকে ৭০ দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মীরা পাকিস্তান সরকারের ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

অন্ধকার ও শোষণের হাত থেকে মুক্তির আন্দোলনে আমরা বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথে এগিয়ে নিয়ে যাই। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতি বিনির্মাণে ব্রতী হই। অন্যদিকে পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিস্ফুট আরেক দল মানুষ মৌলবাদীদের সঙ্গে নিয়ে বাঙালি মুসলমানের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির কথা বলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নামে ৪৭-এর দ্বিজাতি তত্ত্বের সংস্কৃতি আবার প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা ভেবেছিলাম বাংলার মাটি থেকে তাদের চূড়ান্তভাবে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে সেই বিষবৃক্ষের বীজ থেকে আবার অঙ্কুরোদ্‌গম শুরু হয়েছে।

মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলোর প্রতি আবেদন এবং আপাত জৌলুশ ও চমকের বাঙালি উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি শহরে নিম্নবিত্ত তরুণদের মধ্যেও এর অশুভ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বভাবতই প্রতিক্রিয়াশীল ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে আমরা যখন চূড়ান্ত সংগ্রামে লিপ্ত তখন আগ্রাসী সন্ত্রাসবাদের হাত ধরে বিদেশি অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশের এ পথকে আজ রুদ্ধ করা অপরিহার্য। এই অপচেষ্টা থেকে বিপথগামী মিত্রদের চিরাচরিত বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতির সংগ্রামের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। সে ক্ষেত্রে আমাদেরও পশ্চাদমুখীনতামুক্ত রাখতে হবে। আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়েই একুশ শতকের বাঙালি সংস্কৃতি বিনির্মাণ ও বিকাশের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্তের প্রদর্শিত পথে ১৯৬৮ সাল থেকে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী গণসংগীত, নাটক, আবৃত্তি, নৃত্যসহ সব সাংস্কৃতিক মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে। আর বাঙালির প্রাণের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ এই মঞ্চের ওপর বারবার আঘাত এসেছে। এখনো করছে। ১৯৯৯ সালে এই মঞ্চের ওপর বোমা হামলা চালানো হয়েছে। এতে ১২ জনের প্রাণহানি ঘটে। শতাধিক শিল্পী-কর্মী আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। ২০০৫ সালে কিশোরগঞ্জে উদীচী কার্যালয়ে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল। বোমা হামলা চালিয়ে দুজন শিল্পীর অকাল মৃত্যু ঘটানো হলো। দুঃখের বিষয় আজও একটি ঘটনারও বিচার হয়নি।

প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর অত্যাচার-নির্যাতন, রক্ষ চক্ষু উপেক্ষা করে সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তের নীতি-আদর্শ ধারণ করে উদীচী অভীষ্ট লক্ষ্যের পথে যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। উদীচী সংগঠনের যে বীজটি রোপিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে তার শিকড় আজ অনেক গভীরে প্রোথিত ও বিস্তৃত। ঘাত-প্রতিঘাত উতরিয়ে আজ ৫২ বছরে উত্তরণ ঘটেছে। শাখা প্রশাখার পল্লবে বিকশিত হয়ে উদীচী আজ আকাশ ছোঁয়ার অপেক্ষায়। রণেশ দাশগুপ্তের রচিত গঠনতন্ত্রের নির্দেশিত পথ বেয়ে পাঁচ দশকের ঋদ্ধ উদীচী আজ সারা দেশে ৩৩৫টি শাখায় বিস্তৃত। পৃথিবীর বড় বড় শহরে ১৩টিরও অধিক শাখা। গণমানুষের গান গাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে গভীর অন্ধকার থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে আলোক অভিযানে যাত্রা শুরু করে সংস্কৃতি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে যে অবদান রেখেছে তারই স্বীকৃতি রাষ্ট্রের দেওয়া একুশে পদক। সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তসহ অগণিত বিপ্লবী সহকর্মীদের আত্মত্যাগ ও চিন্তা-চেতনার প্রতিফলনই উদীচীর এই একুশে প্রাপ্তি। এমন প্রাপ্তিতে আমরা যেমন আনন্দিত এরূপ একটি সংগঠনের কর্মী হতে পেরে আমরা গর্বিত।

২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন ও শোষকদের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম আর শহীদদের আত্মদানের মূল লক্ষ্য ছিল একটা শোষণহীন সমৃদ্ধিশালী সমাজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ এক গ্লানিকর ও বিপরীত বাস্তবতা আমাদের জীবনকে ঘিরে রেখেছে। গ্রাস করে চলেছে আমাদের স্বাধীনতার বিভিন্ন অর্জন। বিনষ্ট করছে জীবনের সুকুমার দিক। ব্যক্তি সর্বস্ব, সাম্প্রদায়িকতা ও অপসংস্কৃতির দ্বারা লালিত বিকৃত চিন্তা-চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে ব্যক্তি ও সমাজের পরিপূর্ণতা অর্জনের সাধনায় দেশের মানুষ ব্রত হবে এটাই ছিল আশাবাদ। অথচ সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশ চরম হুমকির মুখে।

কিন্তু না অন্ধকারের শক্তি পারেনি। ওরা কখনোই পারবে না। কারণ এ ইতিহাস-এ নৃশংসতার ইতিহাস বহুদিনের। এর মূল সেই একই জায়গায়, বিশ্বজুড়ে সংস্কৃতি বিধ্বংসী ভূমিকায় যারা অবতীর্ণ হয়েছিল। যারা এখনো বামিয়ানে বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করে। যারা সমৃদ্ধ পাহলবী সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করতে বর্ণমালাকে ধ্বংস করেছিল, বাংলা বর্ণমালাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। পারেনি। কিন্তু ওরা থেমেও থাকেনি। তাই আসুন একুশ শতকের আহ্বানে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে, দেশের গণতান্ত্রিক পথ চলাকে সমৃদ্ধ করে অন্ধকারে থাকা হায়নাদের মূলোৎপাটনে অঙ্গীকারবদ্ধ হই। উদীচীর পাঁচ দশকেরও অধিক দীর্ঘ ইতিহাস সে লক্ষ্যেই অব্যাহত আছে। সব রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এই প্রতিজ্ঞাই হোক উদীচীর পাথেয়।