ইলিউশন, ডিলিউশন ও হ্যালুসিনেশন
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছু ঘটে, যার নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আমাদের কাছে থাকে না। কিছুটা রহস্যে ঘেরা, বিভ্রান্তিমূলক, কিন্তু দৃঢ় সত্যের মতো উপস্থিতি। সব মিলিয়ে একটা বিভ্রম জাগানিয়া পরিস্থিতি, যা আপনি বুঝছেন, দেখছেন বা শুনছেন, টের পাচ্ছেন; কিন্তু অন্যরা পাচ্ছে না। তবে কি আপনি পাগল? অবশ্যই না। আপনি পাগল নন! এটা একটা মানসিক স্তর বিন্যাস, যেখানে প্রতিনিয়ত আপনি বিভ্রমের শিকার। এ ধরনের মানসিক পরিস্থিতি নিয়েই আজকের আলোচনা।
অনেকেই হ্যালুসিনেশন সম্পর্কে জানেন। তবে ইলিউশন ও ডিলিউশন সম্পর্কে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। যদিও তিনটি টার্মই ঘুরেফিরে বিভ্রমের সঙ্গেই যুক্ত। এ ক্ষেত্রে এগুলোর মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য, যা বোঝাটা জরুরি।
ডিলিউশন হচ্ছে মানুষের এমন এক অভ্যন্তরীণ শক্তিশালী বিশ্বাস, যার কোনো বাস্তবিক উপস্থিতি নেই। সন্দেহপ্রবণতা ও অনুমান করা হচ্ছে মানুষের মেজর ডিলিউশন। আর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে মানুষের এমন এক অভ্যন্তরীণ শক্তিশালী বিশ্বাস, যার বাস্তবিক উপস্থিতি না থাকলেও কারও মনে হতে পারে যে এটি আছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এর সুস্পষ্ট উপস্থিতি টের পায়, যা অন্য কেউ পায় না। আবার ইলিউশন হচ্ছে মানুষের মনের এমন এক বিভ্রম, যা মূলত ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ কৌশল দ্বারা প্রতারিত হওয়া বা কোনো অবস্থান ও উপস্থিতির ভুল ব্যাখ্যা করাকে ইলিউশন বলে।
কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক—
ইলিউশন: ইলিউশনের অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। যেমন, জাদুর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে হঠাৎ গায়েব করে দেওয়াটা ইলিউশন। একইভাবে ছায়া দেখে তাকে ভূত-প্রেত বা কোনো বস্তুর আকৃতি ভাবা, আয়নায় ছোট জায়গাকে বড় মনে হওয়া, দূর থেকে কারও হাঁটার ভঙ্গি বা চুল দেখে তাকে পরিচিত কারও মতো মনে হওয়া—এসবই ইলিউশন। ইলিউশন মূলত আমাদের চোখকে ফাঁকি দেয়। ইলিউশনের কিছু প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন, অডিটরি, ভিজুয়াল, ট্যাক্টাইল, টেম্পোরাল ইত্যাদি।
ডিলিউশন: ডিলিউশনের উদাহরণের দেখা মিলবে প্রাত্যহিক নানা ঘটনাতেই। এই যেমন, প্রমাণ ছাড়াই অন্যকে সব সময় সন্দেহের চোখে দেখা, কারও ঠোঁট নড়তে দেখেই কী বলা হচ্ছে তা অনুমান করা, কোনো দুর্ঘটনার জন্য অতীতের কোনো কর্মকে দায়ী বলে ভাবা, নিজেকে খুব সুপিরিয়র ভাবা, কেউ নজরদারি করছে এমন ভাবা ইত্যাদি।
অনেক ধরনের ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার রয়েছে। যেমন: পারসিকিউটরি ডিলিউশন, ডিলিউশন অব গ্র্যান্ডিয়র, ডিলিউশনাল জেলাসি, এরোটোমেনিয়া অর ডিলিউশন অব লাভ, সোম্যাটিক ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার, ইন্ডিউস ডিলিউশনাল ডিসর্ডার, ব্যায়ার ডিলিউশন, নন-ব্যায়ার ডিলিউশন, মুড কনগ্রুয়েন্ট ডিলিউশন ও মুড নিউট্রাল ডিলিউশন।
হ্যালুসিনেশন: অলৌকিক কিছুর উপস্থিতি টের পাওয়া, ভৌতিক শব্দ শোনা, অযৌক্তিক গন্ধ পাওয়া, মৃত মানুষের সঙ্গে কথা বলা, অলৌকিক কারও দ্বারা কিছু করতে বাধ্য হওয়া ইত্যাদি হ্যালুসিনেশনের উদাহরণ। হ্যালুসিনেশনে ভোগা অনেকেই শোনেন যে, তাকে কেউ মরে যেতে বলছে এবং অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। হ্যালুসিনেশন কয়েক ধরনের হতে পারে। যেমন: ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন, অডিটরি হ্যালুসিনেশন, ট্যাক্টাইল হ্যালুসিনেশন, অলফ্যাক্টোরি হ্যালুসিনেশন, জ্যাস্টাটরি হ্যালুসিনেশন ও জেনারেল সোমেটিক হ্যালুসিনেশন।
আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ধরুন আপনার স্বামী/স্ত্রী বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু আপনি দেখছেন যে তিনি ঘুমাচ্ছেন না, তিনি কারও সঙ্গে কথা বলছেন। হতে পারে সেটা ফোনে বা ফিজিক্যালি। এটাই হ্যালুসিনেশন। আবার ধরুন আপনার স্বামী/স্ত্রী পরিচিত কারও সঙ্গে সালাম বিনিময় করছেন হাসি মুখে। তা দেখে আপনার মনে হলো, তিনি আসলে সালাম বিনিময় করছেন না, তিনি নিশ্চয়ই ওই ব্যক্তির সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িত। নয় তো তিনি হাসলেন কেন? এটা হচ্ছে ইলিউশন। আর যদি কোনো বাস্তবিক উপস্থিতি ছাড়াই আপনার মনে হতে থাকে যে, আপনার স্বামী/স্ত্রী নিশ্চয়ই আপনার অগোচরে কারও সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িত, তাহলে সেটা ডিলিউশন।
উপসর্গ যা-ই হোক, উপরিউক্ত তিনটি সমস্যাই প্রাথমিক পর্যায়ে সারিয়ে তোলা তেমন কঠিন কিছু নয়। যখনই আপনি নিজে কিংবা পরিবারে বা আশপাশের কারও মধ্যে এ ধরনের কোনো একটি লক্ষণ দেখবেন, সঙ্গে সঙ্গে সে বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হবেন। মনে রাখবেন শরীরের যেমন রোগ হয়, মনেরও তেমনি রোগ হতে পারে।