ভণ্ড পীর ও তাবিজ মোল্লা
দেশে ভণ্ড পীর ও তাবিজ মোল্লাদের প্রতারণা চলছে আদিকাল থেকেই। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত অনেকেই তাদের প্রতারণার শিকার। সব সমস্যার ভোগান্তির সমাধান রয়েছে তাদের কাছে। চিকিৎসকেরা যে সব কঠিন মারাত্মক রোগের চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন, যেসব রোগীর রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসক জানিয়ে দেন, এ রোগীর চিকিৎসা নেই বা বাঁচার দিন ফুরিয়ে আসছে। রোগীর পরিবার–পরিজন কিন্তু হাল ছাড়েন না। সে সময় তারা শরণাপন্ন হন ভণ্ড পীর কিংবা তাবিজ মোল্লাদের দুয়ারে, আকুতি জানান স্বজনকে বাঁচানোর।
ভণ্ডদের কাছে কোনো ব্যাপারই না, সব রোগের চিকিৎসা রয়েছে। গ্যারান্টি সহকারে চিকিৎসা করা হয়। মাঠপর্যায়ে রয়েছে তাদের গুণকীর্তন করার দল। তাদের আস্তানায় যাওয়ার আগে মিলবে তাদের অনেক তথ্য, মিলবে বেশ প্রমাণ যারা তাদের মাধ্যমে ফিরে পেয়েছে নতুন জীবন, মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে শুনাবে তার মিথ্যা কাল্পনিক বানোয়াট কাহিনি। সবই পাতানো, ওরা ভণ্ড পীর ও তাবিজ মোল্লাদের নিয়োগ করা, এদের কাউকে বেতন অথবা কাউকে কমিশন দেওয়া হয়। এভাবেই প্রতারক–ভণ্ডরা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের তাণ্ডব। তাদের কাল্পনিক মিথ্যা কাহিনির গল্প এক জেলা হতে অন্য জেলা কিংবা বিভাগে ছড়িয়ে পড়ে, রয়েছে তাদের এজেন্ট, দেশের ধনী অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করা হয় তাদের কাহিনি। এমনকি পারিবারিক কলহ বা সমস্যা বিভেদ ঝগড়া—এগুলোর সমাধানের নিমিত্তে একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান তারা। স্বামী–স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, অমিল; ভাই–ভাইয়ের কিংবা বাবা–মায়ের সম্পদ আয়ত্ত করা; কাউকে প্রেম বা বিয়েতে রাজি করানো; সবই শতভাগ গ্যারান্টির মাধ্যমে করা হয়। বিনিময়ে গুনতে হবে হাজার হাজার এমনকি লাখ লাখ টাকা। তবে সাক্ষাৎকালে তারা অথবা এজেন্টদের মাধ্যমে জেনে নেয় মক্কেলের আর্থিক অবস্থা। আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করেই খরচের হিসেবে দেওয়া হয়।
যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে, রিপোর্ট, শিরোনাম হয়েছে কিন্তু তেমন কাজ হয়নি। আজও তারা চালিয়ে যাচ্ছে অবলীলায় তাদের ব্যবসা–বাণিজ্য। এ ক্ষেত্রে বিত্তবান কিংবা মধ্যবিত্ত ছাড়াও প্রতারিত হন বহু প্রবাসী। তাদের খুঁটির জোর অনেক। মন্ত্রী, এমপি, পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদের মুরিদ, শুভানুধ্যায়ী। আমাদের সমাজের অনেকেই এদের বিপক্ষে, তারা এসব কুসংস্কার পছন্দ করেন না।
আমার মা আবার তাদের ভক্ত, মায়ের সামনে তাদের সমালোচনা করা যাবে না। মা রেগেমেগে বলতেন মহাপাপ হবে, তওবা করো অন্যথায় বিপদ হবে। জিন–পরি এদের খবরাখবর রাখে, যেথায় ওদের বিরুদ্ধে আলোচনা হয় ওরা জিন–পরির মাধ্যমে জেনে নেয়। তাই মোটেই বাবাদের সমালোচনা করা যাবে না। সেই আদি যুগের মা আমার, তাই মা যাতে মনে আঘাত না পায়, বলতাম ভুল হয়ে গেছে মা। মা তাদের এতই ভক্ত ছিলেন, আমরা ভাই–বোনেরা বিদেশ থেকে প্রতি মাসে মাকে নিয়মিত বড় অঙ্কের টাকা পাঠাতাম। তার আরাম আয়েশ চিকিৎসার জন্য। সিংহভাগ টাকাই প্রতারকদের পকেটে যেত। যেকোনোভাবে প্রতারক দলের এজেন্টদের কাছে খবর চলে যেতো। চেয়ারম্যান বাড়ির আম্মা পীর মোল্লা পাগল। একে একে ওরা মায়ের কাছে আসত এবং বানোয়াট কাহিনি বলে নিয়ে আসত পীর অথবা মোল্লাদের কাছে। হাতিয়ে নিত হাজার হাজার এমনকি লাখ টাকা।
দেশে গেছি, ছোট বোন জানাল অনেক কাহিনি। কীভাবে মাকে ভণ্ডরা প্রতারণার জালে আটকেছে। জিন-ভুত তলব করে চিকিৎসার সমাধান দিয়েছে। কালো খাসি, লাল গরু, স্বর্ণ, রুপা, এগুলো দিতে হবে। কত টাকা সেটা জিন-ভুত বলে দিচ্ছে। এগুলো দিলেই শারীরিকসহ সব ধরনের ঝামেলা থেকে মুক্তি আসবে, অন্যথায় মহাবিপদের সম্মুখীন হতে হবে। এভাবে বেহিসাব টাকা ভণ্ডরা নিয়ে যায়। ৮০ বছরের বৃদ্ধ মা, পরিবারের সবাই মাকে শ্রদ্ধা করত। সবাই জানত, মা প্রতারিত হচ্ছেন। ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস ছিল না।
একদিন ফার্মেসি থেকে মায়ের নিয়মিত সেবন ওষুধের বিল আসে ৪০ হাজার টাকার। রসিকতা হচ্ছে সবাই মিলে, এ সময় কাজের মেয়ে আমার হাতে বিলটি ধরিয়ে দেয়। আমি মাকে বললাম, মা তোমাকে আমরা সবাই বিদেশ থেকে কয়েক লাখ টাকা দিয়েছি। এ টাকা বাকি কেন মা, টাকা কি করেছ? রেগে গেল মা, আমি কোনো জবাব দিতে পারব না। তুমি দিবা, অন্যথায় আমি ধার করে এনে দেব। আমি আর কোনো কথা না বলে টাকাগুলো পরিশোধ করলাম।
একদিন মায়ের পাশে বসে কথা বলছি। হঠাৎ মা বললেন, বাবা আমার একটি আবদার আছে। কী মা, তোমার সবই ন্যায্য পাওনা মা, যা চাইবে তা পাবে। মা ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, সিলেটের খাসদবিরে একজন তাবিজ মোল্লা আছেন। শুনেছি, অনেক লোকজন উপকার পেয়েছে, আমাদের গাড়ি পাঠালে তিনি আসবেন। আমি যোগাযোগ করেছিলাম, ফোনে কথা হয়েছে আমার সঙ্গে। তাবিজ মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। মোল্লা সাহেব জানালেন, তার খুব ব্যস্তসময়। তবে রাতেই আসবেন, তিনি গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসবেন। ভাড়া আসার পর পরিশোধ করতে হবে আলাদাভাবে। রাজি হলাম।
মাকে আমি একটি আবদার রাখলাম। আমি বললাম, মা, হুজুর যেন না জানে আমি আমেরিকা থাকি। আমি এই বাড়ির নিকটাত্মীয় হয়ে পরিচিত হব। তোমার আবদার তো রেখেছি মা, তুমি আমারটা রাখো। মা বলে আবদার যে মিথ্যা। আমি বললাম, মা হুজুর এসে ফিরে যাওয়ার পর এর উত্তর তোমাকে দেব। মা রাজি হলেন, তাবিজ মোল্লা আসলেন। হাতে তখনকার মূল্যবান আইফোন। এতে ডাউন লোড করা জিন ভুতের আওয়াজ ও বিভিন্ন দৃশ্য। যা আমেরিকার স্পেশাল প্রোগ্রামে দেখা যায়। ময়লা একটি শার্ট পরা আমার। মোল্লাকে বললাম, আমি নিকটাত্মীয়। সঙ্গে আসছে তার সহচর। আইফোনের মধ্যে জিন হাজির করা হয়েছে। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠের বিশ্রী শব্দ। সেটা শুধু মোল্লা বুঝতে পারেন।
তাবিজ মোল্লা মায়ের সমস্যাগুলো লিখে নেন কাগজে। জিনকে এক এক করে বলা হলো সব। জিন সমাধান দিতে থাকে। বাড়িতে কেউ তাবিজ পুতে রেখেছে আমাদের অনিষ্ট করতে। এগুলো তুলে নদীতে ফেলতে হবে। মায়ের শরীরে জিনের বাতাস লেগেছে। মাকে কালো জাদু করা হয়েছে এবং এগুলো অল্পদিনে ঠিক হয়ে যাবে। সঙ্গে যে ছিল, সে একা গিয়ে বাড়ির বিভিন্ন স্থান থেকে তাবিজ তুলে নিয়ে এল। আমি তার বাটপারিতে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি, আমার সমর্থনে মা খুশি হচ্ছেন। এবার আমার জবাবের পালা, আমার প্রশ্ন ছিল আমি কেন বিদেশে যেতে পারছি না, কবে হবে অথবা সমস্যা কি? জিন জানাল, এবার হবে। তবে মোল্লার পরামর্শ মোতাবেক, না হলে জীবনে বিদেশ যাওয়া হবে না।
মা যখন আমার সমাধান জিন থেকে শুনতে পেলেন। দেখলাম মায়ের চেহারার পরিবর্তন আসছে। এদিকে মোল্লা বাজেট দিয়েছে আনুমানিক দু লাখ টাকার। বসার ঘরে মোল্লাকে রেখে আমি মাকে তার রুমে নিয়ে গেলাম। মাকে বললাম, এবার বল মা, তোমার কি মতামত এই মোল্লার ব্যাপারে।
দেখলাম, মা লজ্জা পাচ্ছেন। আমাকে মা বললেন, বাবা ওকে গাড়ি ভাড়া দিয়ে বিদায় করে দাও। বলে দাও ফোনে যোগাযোগ করা হবে। এটাই হলো। কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিলাম। ভাবছিলাম উত্তম মধ্যম কিছু দিই, কিন্তু মা বললেন, না বাবা ছেড়ে দে।
এভাবে ভণ্ডদের পেছনে টাকার অপচয় হচ্ছে। অর্থের অভাবে যারা চিকিৎসা নিতে পারছে না, মেঘ বৃষ্টিতে যাদের ছাউনি নেই, তাদের সাহায্য করলে দুনিয়া–আখেরাতে পুরস্কৃত হওয়া যায়। দেশের আইন–প্রশাসন এগুলোর প্রতি নজর না দিলে সরল মনের মানুষেরা প্রতারিত হতেই থাকবে।