ভার্চুয়াল জীবন এখন আর ভার্চুয়াল নেই। এই জীবনের সঙ্গে আমরা নিজেদের এমনভাবে জড়িয়ে ফেলছি যে, এখন এটি বাস্তবের চেয়েও কঠিন বাস্তব হয়ে উঠেছে। খাবার–দাবার ছাড়া দু–একবেলা কাটানো সম্ভব, কিন্তু এ জগৎ ছাড়া জীবন যেন অসম্পূর্ণ। এখানে আমরা নানা সমস্যার বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে গল্প–কবিতা সব বিষয় কেউ কেউ নিজে লিখলেও, সিংহভাগ ক্ষেত্রে হয় কপি–পেস্ট। এই কপি–পেস্ট পোশাক–আশাক থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রসাধনী, জুয়েলারি এমনকি পোস্ট করা ছবি কে কোন অ্যাঙ্গেলে পোজ দিল সেটাও বাদ যায় না। তবে সবাই যে করেন তা নয়, ব্যতিক্রম তো সর্বত্রই আছে। এসব কিছু ঠিক আছে, কিন্তু খুব বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে, আমরা নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে নিজেদের মাঝে অন্যের জীবন পেস্ট করার চেষ্টা করছি। আর তা করছি অনেক সময় অনুমানের ভিত্তিতে। যা দিনে দিনে আমাদের নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে এক বড় সংঘাতে। সে সংঘাত কিন্তু শত্রুর সঙ্গে নয়, অতি আপনজনের সঙ্গে। এতে বাড়ছে অশান্তি, ভাঙছে বন্ধন। না বুঝে মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে সব হারানোর পর হয়তো কেউ বুঝতে পারে, ভুল হয়ে গেছে। সামাজিক মাধ্যম মানুষকে অনেকটাই সরিয়ে দিচ্ছে তার নিজের অবস্থান থেকে দূরে।
যা হোক এখান থেকে শেখার মতো আছে অনেক।
যাদের প্রয়োজন তারা কিন্তু মূল পথেই হাঁটছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে জ্ঞানের কলস সব পরিপূর্ণ হচ্ছে। মাঝপথে খুব সহজ সরল সাধারণরাই হঠাৎ করে বিপজ্জনক হয়ে উঠছেন। সে হোক নর বা নারী। আমি পরে আমার মূল বক্তব্যে আসছি। তো এই কপি–পেস্ট নিয়ে ইংরেজি একটা গল্পের অনুবাদ আছে। যার মূল ব্যাখ্যায় পুরুষদের কটাক্ষ করে দেওয়া এবং পরিশেষে লেখা ‘Lesson learnt: Don’t copy if you can’t paste...PROPERLY’. মূল গল্প:
‘এক সভায় এক বক্তা তাঁর জীবনের নানা গল্প শোনাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি বললেন,
—এত বছর পরে লুকানোর আর কিছুই নেই। আমি জীবনের সবচেয়ে মধুর দিনগুলো এমন এক নারীর সঙ্গে কাটিয়েছি, যে আমার স্ত্রী নয়!’
বলেই বক্তা চুপ!
উপস্থিত দর্শকেরা হতভম্ব! হলজুড়ে পিনপতন নৈঃশব্দ্য!
দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে বক্তা বললেন: ‘সেই নারী ছিলেন আমার মা।’
এই অভূতপূর্ব ব্যাখ্যা শুনে সারা হলো হাততালিতে ফেটে পড়ল। আমার চোখ দিয়েও জল বেরিয়ে এল। আহা! বড়ই অনুপ্রাণিত হলাম। বাড়ি ফিরে গ্লাস নিয়ে বসলাম। চার পেগ গেলার পর বক্তার ওই কথাগুলো মনে পড়ল।
ভাবলাম, বউকে চমকে দেওয়ার এর থেকে ভালো সুযোগ আর হয় না! বউ জানুক আমিও মেধাবী, রসবোধসম্পন্ন সমঝদার এক ব্যক্তি। আমার কথায়ও মেধার স্ফুরণ আছে।
টলটলায়মান অবস্থায় রান্নাঘরে গেলাম। আমাকে ঢুকতে দেখে রান্না করতে করতে ঘেমে নেয়ে একাকার স্ত্রী একবার ভ্রু কুঁচকে তাকাল আমার দিকে।
কোনোরকম ভণিতা না করে আমি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠলাম, ‘এত বছর পরে, লুকানোর আর কিছুই নেই। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর দিনগুলো এমন এক নারীর সঙ্গে কাটিয়েছি, যে আমার স্ত্রী নয়!’
পরের লাইনটা আর মনে পড়ল না, তো মনেই পড়ল না। নেশা চড়ে গিয়েছিল। বউ দেখলাম, ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্র নেত্রে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘাবড়ে গিয়ে বিড়বিড় করলাম, ‘আমার ঠিক মনে পড়ছে না নারীটা কে ছিল!’
পরের দিন হুঁশ ফিরেছিল হাসপাতালের বেডে। সারা গায়ে ব্যান্ডেজ। রুটি বেলার বেলুন দিয়ে মারের চোটে হাত, পা, চোয়াল ভেঙে গিয়েছিল। গরম ডাল পড়ে মাথার চুল উঠে গিয়েছিল। প্রাণে যে বেঁচে গেছি, এই অনেক।’
এত গেল মরতে মরতে বেঁচে যাওয়ার কাহিনি কিন্তু বাস্তবে অনেকেই বাঁচতে পারছেন না। আমরা অনেক গুণীজনকেও হেনস্তা হতে দেখেছি এই সামাজিক মাধ্যমে। যা মারেরও অধিক। এবার আমি তুলে ধরছি মহিলা জগতের কিছু বিষয় যা তারা নিজেদের অজান্তেই ভুলভাবে পেস্ট করছেন এবং সরে যাচ্ছেন অতি আপনজন থেকে দূরে। দূর থেকে এক ভ্রমের মাঝে চলাই এর প্রধান কারণ।
যেমন—ওপরে শুরুতে একটা শব্দ লিখেছি অনুমানের ভিত্তিতে, এটা লক্ষ্য করুন। এই অনুমানটাই কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যা জীবনকে ভুলভাবে পেস্ট করতে অনুপ্রাণিত করছে। অনেক সোশ্যাল সেলিব্রেটি আছেন বা সামাজিক মাধ্যমে হয়তো কোনো কোনো মানুষ আছেন স্বাধীনচেতা, নিজের মতো জীবনযাপন করছেন। অনেকের স্বামীও হয়তো ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তাই কোনো বাধা তার জীবনে আসছে না। তারা ইচ্ছে মতন নিজের স্ট্যাটাস, ছবি পোস্ট করছেন। হোম পেজে প্রচণ্ড রকম সক্রিয়। তাদের লিস্টে কয়েক হাজার মহিলা পুরুষবন্ধু আছেন। তাঁরা হয়তো দেখতেও সুন্দর। যদিও এই এডিট ক্যামেরা, বিউটি ক্যামেরার যুগে প্রকৃত সুন্দর নর–নারী নির্ণয় বেশ ধাঁধার মতো বটে। সব মিলিয়ে দূর থেকে অতি আকর্ষণীয় কিছু মনে হয়। সুন্দরের চেয়েও বড় হচ্ছে স্মার্টনেস।
স্মার্টদের কাজকর্ম অনুসরণ করায় অপরাধ নেই। কিন্তু অনুমানের ভিত্তিতে নিজেকে নিচে নামিয়ে দেওয়া অনেক ক্ষেত্রে জটিল। এরা মনে করেন, তারা করছে তো আমি করলে দোষ কোথায়? এতে যদি নিজের সঙ্গীর সঙ্গে যুদ্ধে নামতে হয়, তাও নামছেন। স্মার্ট ব্যক্তিরা হয়তো নিজের ব্যক্তিত্বে অটল, যথেষ্ট দৃঢ়। হয়তো প্রয়োজনের খাতিরে ঘুরে বেড়ান কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তাদের বিচার করা হয় ভিন্নভাবে। মনে করা হয় তারা স্বাধীন থাকতে পছন্দ করেন, তাদের বাহ্যিক স্মার্টনেসটাই তাদের অস্ত্র। কাজে–কর্মে ব্যক্তিত্বে তারা কতটা স্মার্ট বা গভীর, সেটা খতিয়ে দেখেন না। মনে করেন, অনলাইনে সম্পর্ক করাই তাদের স্মার্টনেসের মূল কারণ। স্বাধীনতা মানে খারাপ কিছু নয়, স্বাধীনতার অপব্যবহার খারাপ। পরাধীন থেকেও অপব্যবহার হয়। তারা এটা বুঝতে চান না। স্মার্টনেসের প্রকৃত সংজ্ঞা কর্মে, পোশাকে নয়। এটি একটি যোগ্যতা যা অর্জন করতে হয়। তিনি বা তারা হয়তো খুব ব্যক্তিত্ববান মানুষ, কিন্তু তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে একটা ভ্রম ধারণার মাঝে থেকে নিজেকে অনেকেই বিপথগামী করে তুলছেন।
বড় ধরনের একটি অঘটন তৈরি হওয়ার পর হয়তো তাদের বলছেন, অমুক আপনার বন্ধু সে আমার সঙ্গে এ রকম সম্পর্ক করেছে, সে কেমন? সে কি আমার কোনো ক্ষতি করবে? আপনার বন্ধু, তাই আমি ভেবেছি খুব ভালো। যাকে জিজ্ঞেস করা হলো সে হয়তো বলছে, ‘আমি তো কখনো তার সঙ্গে কথাই বলিনি যতটা চেনার চিনি হোম পেজে।’ তার ব্যক্তিত্বের মাঝেই হয়তো পড়ে না অনলাইন রিলেশনশিপ বা নিজেকে খুব সস্তা করে ফেলা। কিন্তু আপনি মনে মনে ধরে নিয়েছেন, উনি স্মার্ট। তাই যারাই অনলাইনে আছে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক করাই তার স্মার্টনেস। আপনি নিজে থেকেই একটা ফাঁদে পা দিলেন।
তাই আগে বুঝতে হবে স্মার্টনেস মানে কী? যার মূল প্রতি শব্দ বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমত্তাটি বিভিন্ন উপায়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে: যুক্তি, বুদ্ধি, আত্ম-সচেতনতা, শেখার, মানসিক জ্ঞান, যুক্তি, পরিকল্পনা, সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও সমস্যা সমাধানে যাওয়ার ক্ষমতা। আরও সাধারণভাবে এটি তথ্যকে বোঝার বা মূল্যায়ন করার ক্ষমতা হিসেবে এবং এটি পরিবেশ বা প্রসঙ্গের মধ্যে অভিযোজিত আচরণের জন্য প্রয়োগ করা জ্ঞান হিসেবে বজায় রাখতে পারা। একজন মানুষ তখনই স্মার্ট যখন ওপরের বিষয়গুলো মাথায় রেখে সে নিজের অবস্থান বোঝে।
সুতরাং স্মার্টনেস কাপড়চোপড় বা গেট আপ দিয়ে বিচার করা যায় না। এ জন্য অন্যকে অনুকরণ অনুসরণ করতে গিয়ে নিজের সুখের সংসারকে তুচ্ছ করার আগে একবার ভাবা উচিত, আমি কী করছি?