মনের অন্তরালে
আমি মেয়ে, আমি বোন, আমি স্ত্রী। আমি মা।
বাবা-মা খুব যত্ন করে আমার নাম রেখেছিলেন আলো। আমি নাকি দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছিলাম। তাই বাবা নাম দিয়েছিলেন আলো। বিয়ের আগে বাবার বাড়ি থাকতে প্রায়ই মা বলতেন, বাবার বাড়ি থেকেই মেয়েদের কাজ শিখে নিতে হয়। কয়েক বছর পর তোমার নিজের ঘর নিজের বাড়ি হবে। সেখানে তোমার সবকিছু নিজেকেই করতে হবে। সেদিনই বুঝেছিলাম বাবার বাড়ি তো আমার নিজের বাড়ি নয়। তারপর বিয়ে করে বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়ি এলাম। সবাই আমাকে বুঝিয়ে দিল, আজ থেকে এটাই আমার নিজের বাড়ি। এখন থেকেই এই বাড়িকে মনের মতো করে সাজিয়ে স্বামীকে আপন করে সংসার করবে। সেদিন থেকে শুরু হলো অন্য জীবন।
আমি আমার সবকিছুকে বিসর্জন দিয়ে স্বামীর সংসারকে নিজের ভেবে সবকিছু আপন করার চেষ্টা করি। একদিন সেই নিজের বাড়িতেই বুঝতে পারলাম আমার নিজের বলে কিছু নেই। আমি যে নিজের বাড়িতেই পরাধীন। সেই নিজের বাড়িতে থেকেই স্বামীর হুকুম ছাড়া এক টাকা ব্যয় করার ক্ষমতাও যে আমার নেই। স্বামীর কাছে টাকা চাইলেও শুনতে হয় টাকা দিয়ে কী করব। আবার যদি দেয়ও তার ব্যয়ের হিসাবও যেন রাখতে হয়। কখনো কখনো বড় অসহায় মনে হয়। সংসারের সব কাজ নিজ হাতে করেও আপন বলে কিছুই আমার আপন নেই।
ভেবে দেখলাম যদি নিজেকে একটু স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে পারি, হয়তো নিজের বলে কিছু হবে। কলেজে গিয়ে একটা কোর্সে ভর্তি হয়ে নিজেকে একটা চাকরির উপযোগী বানাতেও স্বামীর অনুমতি লাগে। সেখানেও নিজের ইচ্ছা বলে কিছু নেই। বিয়ের পর সেই অধিকারও যে মেয়েদের নেই। আর নিজের ইচ্ছাকে কাজে লাগালে তখনই সমস্যা। স্বামীসহ অন্যরাও বলবে, অবাধ্য বউ। স্বামীর কাছে এ-ও শুনতে হয়, আমার বাড়িতে এসব চলবে না। আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার কথা মতো চলতে হবে। স্বামীর বাড়ি তো আজ গঠিত হয়েছে বিনা বেতনে আমার অক্লান্ত পরিশ্রম আর সেবায়। তারপরও আমার ভাবার কোনো অধিকার নেই, এটা আমার বাড়ি।
বিয়ের পর একটা মেয়ের পরিচয় শুধু স্বামী আর সন্তান দিয়ে। কোনো কোনো সময় ভয় থাকে, স্বামীর কথা না শুনলে স্বামী তালাক দেবে। তাই এত উৎসর্গের পরও স্বামীর বাড়িও আমার নিজের বাড়ি নয়। স্বামীকে অখুশি করলে একদিন এই বাড়ি ছাড়া হতে হবে। তাই সহজেই মুখ বুঝে মেনে নিতে হয় সবকিছু। সমাজের সব দোষ যে কেবল মেয়েদের। মেয়েরা অবাধ্য। মেয়েদের চালচলন ভালো না। মেয়েরা কুলটা। মেয়েরা ঝগড়াটে। মেয়েরা হিংসুটে। মেয়েরা পতিতা, মেয়েরা তালাকপ্রাপ্ত। সব উপমাই যে মেয়েদের জন্য।
স্বামী আর সংসারের চাপে নিজেকে তৈরি করার কোনো সুযোগই আমার কখনই হয়নি একা পথ চলার। বিসর্জনেই যে মেয়েদের অর্জন এই তো আমরা শিখেছি। বিয়ের কয়েক বছর পর একটা ফুটফুটে সন্তান হলো। তাকে ঘিরে ব্যস্ততার মাঝেও আনন্দের সীমা ছিল না। কখনো কখনো এমন হতো ব্যস্ততার জন্য নিজের চুলে চিরুনি দেওয়ার সময় পেতাম না। তারপরও ভাবতাম এই সন্তান বড় হলে আমার কিছু হবে। সেখানেও আমার স্বপ্ন পূরণ হলো না। আমার সন্তান বড় হতে লাগল, আর বুঝতে পারলাম ও স্বাভাবিক শিশু নয়। তখন যেন আরও কঠিন অধ্যায় নেমে এল জীবনে। এখানেও মা হয়ে শুনতে হলো সন্তান স্বাভাবিক হয়নি এটাও আমার কারণ।
কারণ সব অসফলতা আর অসম্পূর্ণতার দায়ভার যে মায়েদের! মেয়েরা সংগ্রাম করে সারা জীবন কিন্তু তারা থাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরাধীন। মেয়েদের শক্ত খুঁটি গাড়ার কেন কোনো কূল নেই? যেখানে যত শক্তিশালী ঝড়ের আঘাত আসুক না কেন তাদের তুলে ফেলে দিতে পারবে না আর কেউ। অন্যের ভরসা ছাড়াই যেখানে মেয়েরা নিজের বলে ভাবতে পারবে সবকিছু। সিনেমা বা নাটকের মেয়েদের ভূমিকা নয়। আসল বাস্তব চিত্র। আসল বাস্তব কতজন জানে, একটা মেয়ের জীবন কত সংগ্রামের। পুরুষ শাসিত সমাজের অভিমত, স্বামী-স্ত্রী মধ্যে ভালোবাসার প্রধান দায়ভার স্ত্রী। সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে। মদখোর, চরিত্রহীন স্বামীকে ভালোবেসে পরিবর্তন করার দায়ভারও একজন ভালো স্ত্রীর। একটা মেয়ের নিজের কোনো অস্তিত্বই নেই। সে কিসের ওপর ভর করে নিশ্চিত থাকতে পারে। বাবার বাড়ি আজকে ভাইয়ের বাড়ি। স্বামীর বাড়ি সন্তানদের বাড়ি। আমার বাড়ি তো কোথাও নেই। সারা জীবন ত্যাগেই তাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা মেয়েকে বিয়ে দেয় ছেলের শিক্ষা, চাকরি, প্রতিষ্ঠা দেখে। তারা কী এটা ভাবে কখনো, মেয়েকে কার কাছে দিচ্ছে? শিক্ষা যতই থাকুক তার মধ্যে মনুষ্যত্ব না থাকলে সে শিক্ষার কোনো মূল্য নেই।
‘ভালোবাসা’ টাকা বা প্রতিষ্ঠার ওপর নয়। সেখানে দরকার সম্মান, সততা, বিশ্বাস। স্বামীর বাড়ি অনেক বড়-এটা জরুরি নয়। সেই স্বামীর বাড়ি মেয়ের জন্য কতটুকু সম্মান আর আনন্দের এটাই জরুরি। বাবার বাড়ি, স্বামীর বাড়ি, ছেলের বাড়ি কোনোটাই মেয়েদের বাড়ি নয়, তবু আজও আমি বাবার আদরের। আমার সন্তান কবে বুঝবে আমাকে, আমি ওর মা। ওর তো কোনো বন্ধু নেই, আমি-ই ওর বন্ধু। কোনো একদিন আমাকে মা বলে ডাকবে। বায়না করে বলবে মাগো তুমি তোমার পাশে আমাকে আজকে ঘুমাতে নেবে। মাগো তুমি ছাড়া কোনো জীবন্ত প্রাণী এ জগতে আসতে পারত না। তুমি ছাড়া এ জগৎ সংসার অচল মা। আমি আছি সারা জীবন তোমার পাশে। তোমার কোনো ভয় নেই মা।