ট্রাম্প-ন্যান্সির এ কোন খেলা!
এই মুহূর্তে আমেরিকায় চলছে দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের ‘শাটডাউন’। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের জন্য বাজেট বরাদ্দকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংকটে গত ২২ ডিসেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারে এ অচলাবস্থা চলছে। এতে ফেডারেল পদ্ধতিতে পরিচালিত দেশটির ৮ লাখ সরকারি কর্মীর বেতন আটকে গেছে। আর এর মধ্যে নতুন করে ঘি ঢালার কাজটি করছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির দ্বন্দ্ব।
সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর পদটি স্পিকারের। বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) স্পিকারের ব্রাসেলস, মিসর ও আফগানিস্তানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উড়াল দেওয়ার কিছু সময় আগে নিরাপত্তা ও শাটডাউনের অজুহাতে চিঠি দিয়ে এই সফর বন্ধ করেন দেন ট্রাম্প। ন্যান্সিকে দেওয়া ওই চিঠিতে ট্রাম্প লেখেন, ‘এই তথ্য জানানোর জন্য দুঃখিত যে, আপনার ব্রাসেলস, মিসর ও আফগানিস্তান সফরটি স্থগিত করা হয়েছে।’
অথচ ন্যান্সির সম্ভাব্য যাত্রার কয়েক ঘণ্টা পরই সামরিক বিমানে চেপে অবকাশ যাপনে গিয়েছেন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প। ফরচুন ম্যাগাজিনের সংবাদে বলা হয়, বৃহস্পতিবার নিজেদের মালিকানাধীন মার-এ-লেগো রিসোর্টে অবকাশ যাপন করতে ফ্লোরিডায় যান মেলানিয়া—যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উড়োজাহাজই ব্যবহার করা হয়েছিল। সিএনএন ও এনবিসি নিউজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ন্যান্সির বিদেশ সফরটিও সামরিক বিমান চেপে হওয়ার কথা ছিল।
অবশ্য আগেই ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করে তুলোছিলেন ন্যান্সি। গত বুধবার (১৬ জানুয়ারি) এক চিঠিতে ন্যান্সি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এ বছরের (২৯ জানুয়ারি) ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণ বিলম্বে দেওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি চিঠিতে লেখেন, ফেডারেল সরকারে অচলাবস্থার কারণে হাজার হাজার নিরাপত্তাকর্মী ঘরে বসে আছেন। এই অবস্থায় প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রিপরিষদ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও কংগ্রেসের উভয় কক্ষের সদস্যদের নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কাজেই অচলাবস্থা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ভাষণ মুলতবি থাক। তবে ন্যান্সি ট্রাম্পকে নির্ধারিত সময়ে ভাষণটি দেওয়ার ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প উপায়ও বাতলে দেন। ওই চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘আপনি চাইলে এই ভাষণ লিখিত আকারে বিলি করতে পারেন, অথবা হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে বসে ভাষণ দিতে পারেন।’
অবশ্য ১৯১৩ সালের আগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের এই ভাষণ লিখিত আকারে দেওয়ার রীতিই প্রচলিত ছিল। দীর্ঘদিনের রীতি অনুযায়ী কংগ্রেসের সামনে প্রতি বছর এই ভাষণ দেওয়া হয়। রীতি অনুযায়ী স্পিকার ভাষণের জন্য প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে থাকেন।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্পসহ হোয়াইট হাউসের কর্তাব্যক্তিরা ভাবতেও পারেননি যে, এই ভাষণ বাতিল বা মুলতবি হতে পারে। এদিকে চাউর হয়েছে, এ বছর ট্রাম্পের ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণে সীমান্ত নিরাপত্তা ও মেক্সিকোর সঙ্গে দেয়াল নির্মাণের যৌক্তিকতার ওপর জোর দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ইতিমধ্যে ওই ভাষণের খসড়াও সম্পন্ন হয়েছিল। তবে ট্রাম্প এই ভাষণ নিয়ে কী করবেন, তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
প্রেসিডেন্ট-স্পিকার মুখোমুখি এই অবস্থানে অনেকেই শেষ বিচারে ন্যান্সিকে এগিয়ে রাখছেন। তাঁদের যুক্তি হলো বয়স ও রাজনৈতিক দক্ষতা বিবেচনায় ট্রাম্প (৭২) থেকে এগিয়ে রয়েছেন ন্যান্সি (৭৮)। গত মধ্যবর্তী নির্বাচনে নিম্নকক্ষে ডেমোক্র্যাটদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে ন্যান্সির। এ অবস্থায় অনুমিতভাবেই সৃষ্টি হয়েছে ‘ঝুলন্ত পার্লামেন্টের’। ডিসেম্বরে শুরু হওয়া অচলাবস্থা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। ন্যান্সি পেলোসির স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এটি বাস্তব রূপ পায়।
ওয়াশিংটন পোস্ট মন্তব্য করেছে, খেলোয়াড় হিসেবে ট্রাম্পের তুলনায় পেলোসি অনেক বুদ্ধিমান। তবে রিপাবলিকানরা মনে করছেন, প্রেসিডেন্টের ভাষণ প্রসঙ্গে পেলোসির প্রস্তাব রাজনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। অবশ্য তাঁরাও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে, এ খেলায় স্পিকারই জয়ী হতে চলেছেন। রিপাবলিকান এক শীর্ষ নেতার উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ‘টসে পয়সার যে পিঠই উঠুক, বিজয় ন্যান্সির ঘরেই যাচ্ছে।’
মেক্সিকো সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো দেয়াল তৈরির জন্য ৫৭০ কোটি ডলার বরাদ্দ নিয়ে দুই পক্ষের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই অর্থ বরাদ্দ চান। প্রয়োজনে নিজেই শাটডাউনের হুমকি পর্যন্ত দেন। কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা নিরাপত্তার জন্য অর্থছাড়ে রাজি থাকলেও দেয়ালের জন্য একটি সেন্টও দিতে রাজি নয় বলে জানায়।
ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ১৩০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ কিছুতেই তারা অনুমোদন করবে না। দেয়ালের জন্য ট্রাম্পের অর্থ দাবি প্রশ্নে এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষই তাদের অবস্থান থেকে সরেনি। পিউ রিসার্চের জনমত জরিপ বলছে, রিপাবলিকানদের ৬৩ শতাংশ এবং ডেমোক্র্যাটদের ৮৪ শতাংশ দেয়াল প্রশ্নে কোনো রকম আপসের বিরোধী। সম্ভবত নিজেদের সমর্থকদের ভিতকে অক্ষুণ্ন রাখতেই ট্রাম্প অথবা ডেমোক্রেটিক নেতারা মত বদলানোর কোনো তাগিদ পাচ্ছেন না। ডেমোক্র্যাট নেতারা বলছেন, সীমান্ত নিরাপত্তা প্রশ্নে আলাপ-আলোচনা হবে, কিন্তু তার আগে সরকারের কাজকর্ম শুরু করতে হবে। বিপরীতে ট্রাম্পের কথা একটাই, ‘আগে দেয়ালের জন্য অর্থ চাই।’