প্রান্তিক মানুষদের করোনায় সচেতন করতে হবে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি পারিবারিক কারনে বেশ কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে গ্রামের সাধারণ মানুষের সাথে করোনা (কোভিড-১৯) নিয়ে আলাপের সুযোগ হয়েছে। তাদের মাঝে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ এখনো প্রকটভাবে শুরু হয়নি। আর কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সচেতনতা তার চাইতেও কম রয়েছে।

তাদের একটা বড় অংশের ধারণা: 'কোভিড-১৯ বলে আসলে কোনো ভাইরাসের অস্তিত্ব নেই। পুরোটাই গজব বা অভিশাপ। সতর্ক বা সচেতন হয়ে খুব একটা লাভ নেই। তাদের চিন্তার সরলীকরণ দেখে দুঃখের মাঝেও মনে মনে বলার চেষ্টা করি যে, 'যক্ষ্মা, পোলিও, ডিপথেরিয়া, হাম, ধনুষ্টঙ্কার এর মতো রোগগুলোও তো এসেছে। আমরা বাচ্চাদের টিকা দিতে নিয়ে যাই। কথাগুল তাদের জন্য খুব একটা ফলপ্রসূ হয়েছে কিনা বুঝতে পারি না।

তবে এটা বোঝা গেল যে প্রান্তিক পর্যায়ে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে সরকার এবং এনজিও গুলোকে অনেক বেশি কাজ করতে হবে। এবং সেটা করতে হবে প্রান্তিক পর্যায়ে কোভিড-১৯ ব্যপক ভাবে ছড়িয়ে পরার আগেই।

শহরে বা গ্রামে অনেকেই ফেস মাস্ক পড়তে চান না। অনেকেই কোন ধরণের ফেস মাস্ক পরবেন সেটা বুঝতে পারেন না। ফেস মাস্ক কেন পড়তে হবে বা কিভাবে পড়তে হবে সেটা নিয়ে ব্যাপক জনসংযোগ এবং জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিপরীতে ফেস মাস্ক এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়াই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হিসেবে গন্য। সর্বসাধারণের জন্য মেডিক্যাল পিপিই তৈরি বা ক্রয়ে শতকোটি টাকা ব্যয় না করে তার কিছু অংশ ফেস মাস্ক পড়া এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়া সংক্রান্ত জনসচেতনতা তৈরিতে ব্যবহার করলে তার ফল অনেক বেশি সুদূর প্রসারী হবে। স্বেচ্ছাসেবকেরা অনেক বেশি কারিগরি বিষয়ে টাকা এবং শ্রম না দিয়ে, জনসচেতনতা তৈরিতে ব্যপক ভূমিকা রাখতে পারেন।

পত্রিকায় দেখে ছিলাম যে সরকার ফেস মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করেছেন, এবং না পড়লে জরিমানার বিধান রেখেছেন। এখন পর্যন্ত কাউকে জরিমানা করা হয়েছে কি? এই খাতে এখন পর্যন্ত রাজস্ব আয় কত?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

অনেকের কাছেই কোভিড-১৯ খুব নতুন একটা ব্যাপার এবং বেশ দুর্বোধ্য। এর জন্য কেন ফেস মাস্ক পড়তে হবে সেটাও তারা ঠিক বুঝতে পারছেন না। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে গিয়ে হয়তো আমরা 'সমাজবিজ্ঞান' এর চেয়ে 'বিজ্ঞানের' উপর বেশি জোর দিয়ে ফেলেছি। আমাদের সাধারণ মানুষের আচরনগত বৈশিষ্টকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। যেমনঃ “সাধারণ মানুষ কভিড-১৯ বোঝে না, কিন্তু যক্ষ্মা বোঝে। তাই তাকে যদি বলা হয় 'এটা যক্ষ্মার মতোই ভয়াবহ একটি ব্যাধি যা হাঁচি, কাশি এবং থুতুর মাধ্যমে ছড়ায়; এটা প্রিয়জন থেকেও ছড়াতে পারে, আবার প্রিয়জনের মাঝেও ছড়াতে পারে, তাই ফেস মাস্ক পড়ে থাকা (সাধারণ কাপরের হলেও) অনেক বেশি জরুরী'; এবং আক্রান্তের থুতু বা কফ হাতে লেগেও সেই হাতে থেকেও কোভিড-১৯ ছড়াতে পারে, তাই সাবান দিয়ে হাত ধোয়া অনেক জরুরি। - তখন হয়তো অনেকেই বুঝতে পারবেন সরকার এবং চিকিৎসক কেন ফেস মাস্ক পড়ার কথা বেশি বেশি বলছেন।

সাধারণ মানুষ যে ভাষা বোঝে সেই ভাষায় তাকে বোঝাতে হবে। আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, লকডাউন, কমিউনিটি ট্রান্সফারের মতো ভারী ভারী শব্দ সাধারণ মানুষের মাথার উপর দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা অনেক বেশি কার্যকরী সমাধান দিতে পারবেন আশা করি।

কোভিড-১৯ সংক্রমণের বর্তমান রেখচিত্র
মোটামুটি ২৫ মে থেকেই বাংলাদেশে কোভিড সংক্রমণের হার ২১ শতাংশের আশে পাশে ঘোরাঘুরি করছিল। ঈদের মাঝে লকডাউন সিথিল করা এবং সাধারণ মানুষের গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাওয়াতে ধারণা করা হচ্ছিল যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এবং শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। ঈদের পর থেকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কোভিড-১৯ পরিস্থিত জটিল আকার ধারণ করেছে বা ধারণ করতে যাচ্ছে। আগেও একবার বলেছি যে আমাদের জন্য একটা সুন্দর সুযোগ ছিল এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে। তখন সংক্রমণের হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। আমরা যদি রমজান মাসে কড়াকড়িভাবে লকডাউন করতে পারতাম তাহলে মে মাসের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ অনেকটুকুই নিয়ন্ত্রনে থাকতো। কিন্তু হালিম, জিলাপি, ঈদ শপিং, মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ আদায়, ঈদে বাড়ি ফেরা, ইত্যাদি কারণে জনমনে এবং তাদের চালচলনে একটা ঢিলেঢালাভাব চলে আশে। জুন মাসে সংক্রমণের হার দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া তারই আফটার ইফেক্ট।

আমরা জুন মাসের এই পর্যায়ে যদি সংক্রমণকে সাড়া দেশে ছড়িয়ে পড়তে দেই, তাহলে সংক্রমণের হার এই মাসের শেষ নাগাদ আরও বৃদ্ধি পাবে। সেটা বৃদ্ধি পেয়ে কোথায় থামবে তা আমরা কেউ সঠিকভাবে আগাম বলতে পারব না। কিন্তু এটা অনুমেয় যে আমাদের দুর্বল কাঠামোর স্বাস্থ্যখাতের ভয়াবহতা বহন করতে পারবে না। তাই সংক্রমণ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করার আগেই সেটার রাশ চেপে ধরতে হবে। এবং তা এখনি। সরকার এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পারে নিজেদের মাঝের সমন্বয়হীনতা দূর করে কোভিড-১৯ সংক্রমণ হ্রাসে তাদের কর্মপরিকল্পনা সাধারণের সাথে শেয়ার করে সচেতনতা বাড়াতে। ইতিমধ্যেই সাধারণ মানুষ লকডাউন, রেডজোন, ইয়েলোজোন এবং গ্রিনজোন ইস্যুতে অনেকটাই ধোয়াশার মাঝে আছে।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

একটা কিঞ্চিত পজিটিভ সম্ভাবনার কথা দিয়ে শেষ করছি, ২৫ মে থেকে শুরু করে গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে কোভিড সংক্রমণের হার ২১ শতাংশের আশে পাশে ঘোরাঘুরি করছে (১৯ থেকে ২৩ শতাংশ), যা গত দুই দিনে অল্পঅল্প করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মে মাসের শেষের দিকে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার টেস্ট করা হতো, যা বর্তমানে প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু সামগ্রিক সংক্রমণের হারের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। প্রথম দিকে ঢাকা শহর, বৃহত্তর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজিপুরেই সংক্রমনের হার ছিল সবচেয়ে বেশিঃ সামগ্রিক সংক্রমণের প্রায় ৮০ শতাংশ। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে সংক্রমণের হার দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেইক্ষেত্রে সংক্রমণের হার বেশ বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। তাহলে একটা সম্ভাবনা থাকে যে গত দুই সপ্তাহে দেশের অন্যান্য অংশে সংক্রমণ বাড়লেও ঢাকা শহর, বৃহত্তর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজিপুরে সংক্রমণের হার স্থিতাবস্তায় আছে অথবা দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় হ্রাস পেতে শুরু করেছে। তাই সামগ্রিক সংক্রমণের হার খুব একটা বেড়ে যায় নি। আইইডিসিআরের উপাত্ত অনুযায়ী বর্তমানে সামগ্রিক আক্রান্তের প্রায় ৫৫ শতাংশ ঢাকা শহর, বৃহত্তর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজিপুর থেকে।

তথ্য উপাত্তের সল্পতার জন্য ঢাকায় কোভিড-১৯ সংক্রমণের হারের বর্তমান অবস্থার গভীর বিশ্লেষণ করা কঠিন। কিন্তু এই সম্ভাবনাটি যদি সত্যিও হয়, তাহলেও আমাদের নড়বড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার হেতু আমরা খুব শীঘ্রই সেটার প্রভাব দেখতে পাব না। উপরন্ত দেশের অন্যান্য অংশের মারাত্মক ভাবে সংক্রমিত রোগীদের একটা বড় অংশ ঢাকাতেই চিকিৎসা নিতে আসতে পারেন।

*শিক্ষক, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বুয়েট