বাজেট: ভাঙা রেকর্ড ও জীবনের যত হিসাব
জুন মাস এলেই চারদিকে বিরাজ করে কেমন একটা চাপা উত্তেজনা। নানা রকমের চুলচেরা বিশ্লেষণ, হিসাব-নিকাশ, আলোচনা আর সমালোচনা। কারণ এ মাসেই পেশ এবং পাস হয় জাতীয় বাজেট। যদিও করোনা তাণ্ডবে এ বছরের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। বাজেটকে ঘিরে নেই আগের বছরগুলোর মতো সেই উত্তেজনা। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আলোচনা হচ্ছে ভিন্ন মাত্রায়, নতুন আঙ্গিকে।
বাজেটকে কেন্দ্র করে আমাদের এখানে প্রচলিত কিছু কর্মকাণ্ড অনেকটা রিচুয়ালের পর্যায়ে চলে গেছে। যেমন বাজেট ঘোষণা শেষ না হতেই একপক্ষ বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে নেমে যায় মিছিলে। মনে হয়, এর চেয়ে ভালো বাজেট কেউ কখনো দেখেনি আগে! অন্যপক্ষ থেকে চলে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, ‘গণবিরোধী কালো বাজেট মানি না, মানব না।’ কারও বা কণ্ঠে আবার প্রতিধ্বনিত হয়, ‘গরিব মারার এই বাজেট বাতিল করো, করতে হবে।’ উভয় পক্ষই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করায় বেশ করিতকর্মা। ব্যানার, ফেস্টুনসহ মিছিলে ব্যবহৃত নানা সামগ্রী এত দ্রুতগতিতে কীভাবে তৈরি হয়ে যায়, তা সত্যিই বিস্ময়কর!
দুষ্ট লোকেরা বলে, এগুলো নাকি আগে থেকে প্রস্তুত থাকে! ব্যাপারটা কী দাঁড়াল তাহলে? বাজেট যা-ই হোক, বেশির ভাগ বক্তব্যই থাকে পূর্বনির্ধারিত! ক্রিকেটের পরিভাষায় যাকে বলা হয়: প্রিমেডিট্যাটেড শট—অর্থাৎ বল যা-ই হোক না কেন, ব্যাটসম্যান তাঁর মতো করে আগে থেকে ভেবে নেওয়া শট খেলবেন। এ রকম ক্ষেত্রে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে বেশি!
একটি বিতর্ক আমাদের বাজেটে অবধারিত ভাবে থাকে—টাকার রং: সাদা না কালো? কালোটাকা সাদা হবে কি হবে না? প্রতিবারই বলা হয়, এবারই শেষ সুযোগ। দুঃখজনকভাবে দিন শেষে কালোটাকার মালিকেরা কেন জানি এই সুযোগের সদ্ব্যবহারের ব্যাপারে তেমন একটা উৎসাহী হন না। কাজেই প্রতিবারই এ খাত থেকে সরকারের আয় হয় যৎসামান্যই! তার পরও প্রতিবছর একই সুযোগ অব্যাহত থাকে। সত্যিকার করদাতাদের জন্য ব্যাপারটা হতাশাজনক। কেননা কোনো নাগরিক যদি নিয়ম মেনে যথাসময়ে কর দেন তবে তাঁকে অনেক ক্ষেত্রে ২৫ বা ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। অথচ কেউ যদি আইন অমান্য করেন, তাঁর জন্য এই হার মাত্র ১০ শতাংশ!
সাম্প্রতিককালে বেশ আলোচনা হচ্ছে বাজেটের আকার-আকৃতি নিয়ে। দেশ এগোচ্ছে, অর্থনীতি বড় হচ্ছে, স্বাভাবিক কারণে বাজেটের আকারও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে প্রশ্ন থাকে: কত বড় হলে এটিকে যথাযথ বলা যায়? বিরোধী পক্ষের অভিযোগ, উচ্চাভিলাষী বাজেট। এই বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা আমাদের নেই। এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে জনগণের ওপর বাড়বে অযথা বাড়তি করের বোঝা। অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহ করতে সরকারের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে, ফলে ব্যক্তি শ্রেণির উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ পাবেন না। বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, নতুন নতুন কর্মসংস্থান হবে না, দেশে বেকারত্ব বাড়বে। অন্যদিকে বাজেট প্রণেতারা বলেন, এটি স্বপ্নদর্শী বাজেট। লক্ষ্য যদি বড় না হয়, তবে দেশ এগোবে কীভাবে? এই বিতর্ক বিগত প্রায় এক দশক ধরেই চলছে।
অনুসন্ধিৎসু মন জানতে চায়, প্রকৃত ব্যাপারটা কী? আমাদের দেশে অনেক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ আছেন। তাঁরা কী অনুগ্রহ করে বলবেন, বাজেটের পরিকাঠামো আসলে কেমন হওয়া উচিত? রাজস্ব আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা—এ নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছানো কী খুব বেশি কঠিন?
জুন মাস এলে আরেকটা ব্যাপার বেশ লক্ষণীয় হয়, সরকারি প্রকল্পে টাকা খরচের হিড়িক। জুনের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ না করতে পারলে তা তামাদি হয়ে যায় অর্থাৎ বরাদ্দকৃত অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত চলে যায়। সে কারণে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম সাত-আট মাসে যেখানে এডিপি বাস্তবায়নের হার থাকে ৪০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে, সেটাই বছর শেষে হয়ে যায় ৯০ শতাংশের বেশি! স্বাভাবিক কারণে প্রশ্ন ওঠে, শেষের দিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কোন জাদুর পরশে এত বৃদ্ধি পায়? তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কি আপস করা হয় কাজের গুণগত মানের সঙ্গে? এ বছরে এডিপি বাস্তবায়ন পরিস্থিতি গত দুই অর্থবছরের তুলনায় বেশ নাজুক। প্রথম আট মাসে বাস্তবায়নের হার মাত্র ৩৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। বছর শেষে এই হার হয়তো সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
বাজেট পেশের পরের দিনের সব পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়, ‘কোন কোন পণ্য দাম বাড়বে, আর কমবে কোনগুলোর।’ দাম বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে একটি ব্যাপার লক্ষণীয়—বাজেট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জিনিসের দাম বেড়ে যায়। আর কমা? তা নিয়ে চলে নানা বাহানা! সত্যিকার অর্থে আমাদের এই টানাপোড়েনের অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের কাছে বাজেট মানেই হিসাব মেলানো, তাই পণ্য বা সেবার দাম হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক অঙ্ক।
হিসাব মেলানোর কাজটা আসলেই ভীষণ কঠিন। সহজে মেলে না। এ নিয়ে জীবন থেকে নেওয়া কিছু কথা: ৪০ বছর সংসার করার পর স্ত্রীর খেদোক্তি, ‘কী পেলাম তোমার সংসারে এসে? তখন যদি বাবার কথা মেনে আতিক ভাইকে বিয়ে করতাম আজকে রানির হালে দিন কাটত আমার। না হয় একটু ট্যারাই ছিল, লক্ষ্মীট্যারা!’ নিজের অজান্তেই স্বামীর দীর্ঘশ্বাস ‘সেই বাসন্তী, আহা, সেই বাসন্তী এখন বিহারে, ডাকাত স্বামীর ঘরে চার সন্তানের জননী হয়েছে।’ হিসাব মেলে না!
—প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলের সেমিস্টার ফি আর অন্যান্য খরচ বাবার মাইনের চেয়ে অনেক বেশি। তাহলে বাকি টাকা আসে কোত্থেকে? ছেলে জানে, বাবার আয়ের উৎস। কিন্তু অত সব ভাবার সময় নেই। ছেলে যখন জন্ম দিয়েছে তখন তার শখ-আহ্লাদ পূরণ করা বাবার পবিত্র দায়িত্ব!
—গা-ভর্তি দামি গয়না আর জমকালো শাড়ির ভারে স্ত্রী ভীষণ খুশি! হালাল-হারাম? ওটা মিনসের ভাবনা! বিয়ে করেছে, বউয়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেবে না? হিসাব মেলে না।
—পাড়ার মসজিদে এসি লাগানো হয়েছে। মুসল্লিরা দারুণ খুশি! আকরাম সাহেব একজন উচ্চপদস্থ সৎ কর্মকর্তা। ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে দান করেছেন?’ মেহেদি রাঙানো দাড়ি হাতাতে হাতাতে ইমাম সাহেব তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলেন, ‘অমুক ইন্সপেক্টর সাহেব। বড় পরহেজগার!’ আকরাম সাহেব জানেন, তাঁর চেয়ে ১০ গ্রেড নিচের বেতন স্কেলে কাজ করেন ওই ‘দানবীর’! ইমাম সাহেবের জানার প্রয়োজন নেই টাকার উৎস হালাল না হারাম। জো আপসে আপসে আইয়ে ওহি হালাল হ্যায়! হিসাব আসলেই মেলে না।
—বেলাল সাহেব অনেক শখ করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন বড় ঘরে। অবস্থাপন্ন পরিবার। কিন্তু জীবনের সব সঞ্চয় শেষ হয়ে গেল মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আবদার মেটাতে। না যৌতুক নয়! শরিফ পরিবার। মেয়ে আর জামাই যেন একটু আরামে থাকে তার জন্য যত্সামান্য কিছু আসবাব—এসি, টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি ইত্যাদি...। হিসাব মেলে না।
—সরকারি হিসাবে দেশে খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রকৃত হিসাব নাকি এর তিন গুণ! অথচ এই দেশেই ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের বসতবাড়ির টিনের চাল খুলে নেওয়া হয়। আপনি যত বড় খেলাপি, তত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকগুলো আপনার পিছে ঘুরবে টাকার বস্তা নিয়ে, আপনাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রভাবশালীদের ঘুম হারাম। জেপি গেট্টির সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘ব্যাংক যদি আপনার কাছে ১০০ টাকা পায় তবে সেটা আপনার সমস্যা। অন্যদিকে, ব্যাংক যদি কারও কাছে ১০০ কোটি টাকা পায় তবে সেটা ব্যাংকের সমস্যা!’ কী বুঝলেন? হিসাব কি মেলে?
হিসাব মেলানো আসলেই কঠিন। পৃথিবীর সব অর্থমন্ত্রীর জন্য তাই সহমর্মিতা আর অনেক অনেক শুভকামনা। আর আমরা—আমজনতা? হিসাব মেলাতে মেলাতে একদিন মিলিয়ে যাব শূন্যে, মহাশূন্যে।
*বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। লালমাটিয়া, ঢাকা। [email protected]