চা পানে করোনা থেকে মুক্তি, কতটুকু সত্যি
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) নিরাময়ের মহৌষধ লুকিয়ে আছে চায়ের মধ্যে! চীনের হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিদিন তিনবার করে চা পান করানোর মাধ্যমে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করে তুলছেন। বার্তা সংস্থা ‘সিএনএন’ আর ‘চায়না ডেইলি নিউজ’–এর বরাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি লেখায় এমনটিই দাবি করা হচ্ছে।
এসব লেখায় তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে চীনের ডাক্তার ‘লি ওয়েনলিয়াং’–এর নাম, যিনি প্রথম করোনাভাইরাস সম্পর্কে বিশ্বকে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন। ফলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে চা–শিল্পসংশ্লিষ্ট অনেকেই ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে এই দুর্দান্ত খবর ছড়িয়ে দিচ্ছেন পরিচিতজনদের মধ্যে।
বহুল প্রচারিত সেসব লেখার মূল বক্তব্য অনেকটা এ রকম, ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং মৃত্যুর পূর্বে ‘কোভিড-১৯’ আক্রান্ত রোগীদের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে এই ভাইরাস থেকে বাঁচার একটি উপায় বলে গেছেন। তিনি ‘মিথাইল জ্যানথিন’ নামে একটি প্রাকৃতিক উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন, যা ক্যাফেইন, থিয়োব্রোমিন, থিয়োফিলিন ইত্যাদি জৈব পদার্থের রাসায়নিক সংমিশ্রণ। এই উপাদানগুলোর সব কটিই চায়ের মধ্যে বিদ্যমান। সুতরাং, দৈনিক তিনবার চা পান করলেই নাকি করোনাভাইরাস নিরাময় সম্ভব!
সারা দুনিয়ার বিজ্ঞানী ও গবেষক দল যখন দিনরাত এক করে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় খুঁজছেন, সেই আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে এমন সুখবর নিঃসন্দেহে আশার বাণী শোনায়। কিন্তু চা পানের মাধ্যমে করোনা নিরাময়ের দাবি আসলে কতখানি সত্যি, তার বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধান একান্ত প্রয়োজন।
সম্প্রতি করোনাভাইরাস প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে গিয়ে তাইওয়ানের একদল গবেষক বেশ আশাব্যঞ্জক সাফল্য পেয়েছেন। তাঁদের প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের তথ্যমতে, চা থেকে প্রাপ্ত ‘থিয়াফ্লাভিন’ এর মধ্যে কোভিড-১৯’সহ করোনার আগের দুটি সংস্করণ সার্স ও মার্স ভাইরাসের বিস্তার রোধ করার গুণাবলি বিদ্যমান। করোনাভাইরাস মূলত ‘আরএনএ ডিপেনডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ’ (সংক্ষেপে ‘আরডিআরপি’) নামক একধরনের এনজাইমের সহায়তায় প্রাণিদেহে নিজের অসংখ্য অনুলিপি (রেপ্লিকা) তৈরির মাধ্যমে সংখ্যাবৃদ্ধি করে। চায়ের থিয়াফ্লাভিন এই এনজাইমের কার্যকারিতায় বাধা প্রদান করে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে সক্ষম (সূত্র: ‘দ্য পটেনশিয়াল কেমিকেল স্ট্রাকচার অব এন্টি-সার্স-কোভ-২ আরএনএ ডিপেনডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ’, জার্নাল অব মেডিকেল ভাইরোলজি, মার্চ ১৩, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত)।
তবে এই গবেষণা কার্যক্রমের ভিত্তিতে প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য প্রাণী ও মানবদেহে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) করা এখনো বাকি। তাই চায়ের থিয়াফ্লাভিন করোনাভাইরাস নিরাময়ে আসলেই কতখানি কার্যকর, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। সে যা–ই হোক, নিঃসন্দেহে এই গবেষণার খবর চা-প্রেমী মানুষদের মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি জোগাবে।
এবার এই নিবন্ধের শুরুতে উল্লিখিত সেই সাড়া ফেলে দেওয়া লেখাগুলো কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য, সেদিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। ইতিমধ্যেই সংবাদ সংস্থা বিবিসি, ইন্ডিয়া টুডেসহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নিশ্চিত করেছে সিএনএন, চায়না ডেইলি নিউজ এবং চক্ষুবিশেষজ্ঞ লি ওয়েনলিয়াংয়ের নাম ব্যবহার করে যে তথ্যগুলো ছড়ানো হচ্ছে, তা একদমই মনগড়া। বাস্তবে চীনের হাসপাতালগুলোতে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের কোনো ধরনের ‘চা চিকিৎসা’ দেওয়া হচ্ছে না (সূত্র: বিবিসির ‘করোনাভাইরাস: ডাজ ড্রিংকিং টি হেল্প? এবং ইন্ডিয়া টুডে’র ‘ফ্যাক্ট চেক: ভাইরাল পোস্ট ক্লেইমস চায়না’স হুইসেলব্লোয়ার ডক্টর সাজেস্টেড টি কিওরস কোভিড-১৯’ নিবন্ধ)। সুতরাং ‘চা পান করলেই করোনা থেকে মুক্তি মিলবে’—এমন খবর অন্তরে সাময়িক প্রশান্তি জোগালেও আদতে সেটা বিজ্ঞানের ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রচার। এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক খবর যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাই উচিত।
একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে সবার বোঝা দরকার, রোগের ঝুঁকি কমানো এবং রোগ নিরাময় করা— দুটি কিন্তু এক জিনিস নয়। চায়ের নির্যাসে বিদ্যমান মূল্যবান প্রাকৃতিক উপাদানগুলো মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম। কিন্তু চা কোনো প্রতিষেধক নয়। অতএব শুধু চা পান করেই এই ভয়াবহ ভাইরাস থেকে মুক্তি মিলবে—জনমনে এমন আশা না করাই উত্তম।
সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতার। তাই একদিকে যেমন সংক্রমণের মাধ্যম, আক্রান্ত রোগীর লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায় জানা জরুরি, ঠিক তেমনি এ সম্পর্কে ছড়ানো যেকোনো গুজব কিংবা ভুল তথ্য সম্পর্কে সচেতন থাকাও দরকার। সারা বিশ্বে প্রতিদিন অবিশ্বাস্য গতিতে করোনায় আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ এখনো লাগামহীন না হলেও যে হারে গুজব আর ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে, সেটাও ভাইরাসের চেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
বহুকাল আগে সৈয়দ মুজতবা আলী ম্যালেরিয়া জ্বরের ওষুধ কুইনাইন প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?’ বাংলাদেশের জনগণ যেভাবে থানকুনিপাতা, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ, লবন মেশানো গরম পানি কিংবা চা খেয়েই করোনা সারানো শুরু করেছে, তাতে প্রশ্ন উঠতেই পারে—হুজুগে এই জাতির ‘গুজব ভাইরাস’ সারবে কিসে?
*লেখক: চা গবেষক