ছোট কাঁধ কি বড় ব্যাগের ভার বইতে পারছে
শহরের একটি সচরাচর দৃশ্য যে ব্যাগের ভারে হয়তো ঝুঁকে হাঁটছে শিশুটি। অথবা দেখা যায়, সন্তানের ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে চলেছেন তাদের মা–বাবা কিংবা অভিভাবক। পথ চলতে চলে দেখা যায়, স্কুলগামী বা স্কুলফেরত ছোট ছোট শিশুর ঘাড়ে ঝুলছে বড় ব্যাগ। বইয়ের সমাহার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, খেলাচ্ছলেই শিখবে শিশুরা। আনন্দ-খুশির মধ্য দিয়ে মনের অজান্তেই শিখবে। পড়াশোনায় আনন্দ থাকবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তা বলে না। স্কুল বা কোচিং যাওয়া-আসায় বইয়ের পাহাড় আর পড়াশোনার চাপ।
অনেক ক্ষেত্রে আমরা উল্টাপথে যেতে পছন্দ করি। শিক্ষাক্ষেত্রেও তা–ই। প্রাইমারিতে বইয়ের চাপ বেশি, মাধ্যমিকে তুলনামূলক কম। কলেজে অনেক কম। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার শিট নিয়ে গেলেই হয়। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে বইয়ের বোঝা কমছে। কিন্তু উল্টোটাই হওয়ার কথাই ছিল।
দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন নামকরা স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিশুর ব্যাগের ওজন তিন কেজির বেশি। আবার ইংলিশ ভার্সনে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন গড়ে চার কেজির বেশি। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন পাঁচ কেজির বেশি। কিন্তু চিকিৎসকেরা বলছেন অন্য কথা। তাঁরা বলছেন, পাঁচ বছরের একটি ছেলেশিশুর আদর্শ ওজন ১৮ দশমিক ৭ কেজি, আর মেয়ের ১৭ দশমিক ৭ কেজি। ছয় বছরের একটি ছেলেশিশুর আদর্শ ওজন ২০ দশমিক ৬৯ কেজি আর মেয়ের ১৯ দশমিক ৯৫ কেজি। সে হিসাবে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন তার শরীরের ওজনের ১০ শতাংশ, অর্থাৎ সর্বোচ্চ ২ কেজি হওয়ার কথা। সেখানে ঢাকার খ্যাতনামা বিভিন্ন স্কুলে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন পাওয়া গেছে সর্বনিম্ন ৩ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ কেজি।
যদিও বই জীবনীশক্তি সঞ্চার করে, মনের ক্ষুধা মেটায়, অন্তর্চক্ষু খুলে দেয়। অসংখ্য চোখ প্রস্ফুটিত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে বই। জগতের ইতিহাস-ঐতিহ্য, নীতি-আদর্শ, কৃষ্টি-সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ তাবৎ জ্ঞান বইয়ের মধ্যে থাকে। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বই পড়ছে কি? বই পড়ার চর্চা না থাকলে কীভাবে ওদের অন্তর্চক্ষু প্রস্ফুটিত হবে! এখনকার শিশুরা ছড়া-কবিতা-গল্পের বই পড়েই না বলা চলে। এ দায় পুরোপুরি শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। পাঠ্যবইয়ের চাপেই শিশুদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এর সঙ্গে আবার যোগ হয় অসংখ্য অনুমোদনহীন বইয়ের বোঝা। এসব বইয়ের চাপ সামলিয়ে শিশুরা ছড়া, কবিতা আর গল্পের বই পড়বে কখন। কিন্তু স্কুল, কোচিং আর গৃহশিক্ষকের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা শিশুদের কাছে গল্পের বই পড়া যেন বিলাসিতা। কিন্ডারগার্টেন আর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোয় চলছে নৈরাজ্য। এদের সামলানোর কেউ নেই। প্রি-প্রাইমারি স্তরেই শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ছয়–সাতটি বইয়ের বোঝা। কিন্তু কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বই কমতে থাকে।
একদিকে বাড়তি বই পড়ার চাপ, অন্যদিকে কোচিংয়ের জন্য চাপ—এসব সহ্য করতে না পেরে শিশুরা প্রায়ই অসুস্থ হচ্ছে। বই, খাতা, কলম, পানির বোতল, খাবারসহ প্রতিটি শিশুকে বিশাল ব্যাগ বহন করতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি পার হলেই শুরু হয় অনুমোদনহীন বই পড়ানোর চাপ। প্রত্যেক শ্রেণিতে সরকার অনুমোদিত বইয়ের বাইরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া বই পড়তে বাধ্য হয় শিশুরা। বিশেষত, শহরাঞ্চলের স্কুলে প্রাথমিক স্তরের শিশুদের ওপর অতিরিক্ত বই চাপিয়ে দিচ্ছে বেসরকারি নামীদামি স্কুলগুলো। কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের ১৩-১৪টি বিষয় চাপিয়ে দেওয়া হয়। এখন গ্রামাঞ্চলেও অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন স্কুল হয়ে গেছে। এগুলোয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান কোচিংনির্ভর হয়ে গেছে। আমাদের দেশে ছোট শিশুদের একাদিক ভাষার শিক্ষা দেওয়া হয়। বাংলা ও ইংরেজি তো আছেই। সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা। এখানে আরবি বা সংস্কৃতি ভাষাও শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তাহলে দেখা যায় কমপক্ষে তিন ভাষা চলমান রয়েছে। এ ছাড়া বিজ্ঞানের বিভিন্ন টার্ম তো আছেই। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে শিশুর মনে ভাষা গ্রহণ করার ক্ষমতাও। একসঙ্গে একাধিক ভাষার শিক্ষাগ্রহণ মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্বল্প মেয়াদে কয়েকটি ভাষা শেখানো হলেই তা কাজে লাগবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই কিন্তু।
ছোটদের বড় পরীক্ষা দুটো। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি)। দুটো পরীক্ষারই অবসান হওয়ার দরকার। প্রধানমন্ত্রীও নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু কঠোর বাস্তবায়ন চাই। প্রধানমন্ত্রী আরও একটি নির্দেশনা দিয়েছেন সম্প্রতি। তিনি বলেছেন, শাখা (বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসা প্রভৃতি) মাধ্যমিকে হবে না। উচ্চমাধ্যমিকে হতে হবে। এটা বাস্তবায়ন করা গেলে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে। ছোট শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মানসিক চাপে থাকে। মূলত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিভাবকেরাই এ চাপ সৃষ্টি করে থাকেন।
শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য উন্নত বিশ্ব বা পাশের দেশ ভারতও শিশুদের ওপর থেকে বইয়ের চাপ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। শ্রেণি অনুসারে বইয়ের সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি ভারত শ্রেণিকক্ষে বইবিহীন শিক্ষা প্রকল্প শুরু করেছে। বই কমানো বা পড়াশোনার চাপ কমানোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও আদালতও রায় দিয়েছেন। কিন্তু আজও পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবসাকেন্দ্রের মতো হয়ে গেছে। সরকারকে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখানে নিয়ন্ত্রণ আনতে কঠোর হতেই হবে। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। আপাতত আর কিছু না হোক, অন্তত অনুমোদনবিহীন বইয়ের চাপমুক্ত করতে হবে। আনন্দযুক্ত হোক শৈশবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিনিয়ত ভারী বইয়ের বোঝা কাঁধে বহন করার কারণে শিশুরা আর্থ্রাইটিস ও অস্টিওপোরোসিসের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে, যা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এটির নেতিবাচক প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে রাজধানীতে। অনেক শিশু কাঁধব্যথায় ভুগছে। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা শিশুদের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। এটা কিন্তু বড় ব্যাগ ঘাড়ে ঝুলিয়ে রেখে ছুটছে। অনেক সময় ল্যাপটপের ব্যাগ ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করলে কাঁধে ব্যথা হয় আমাদেরও। আর শিশুদের ছোট কাঁধে একাধিকবার বড় ব্যাগ উঠছে এবং অনেক দূর বা অনেক সময় ধরে ঝুলছে। এতে শিশুদের মধ্যে পিঠব্যথার হার দিন দিন বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভার বহন করা উচিত নয়। এতে শিশুদের পিঠ ও পায়ে ব্যথাসহ বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুরা হয়ে যেতে পারে বামন বা খর্বাকৃতির। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসা দুবার করে ব্যাগ টানতে গিয়ে এসব শিশু শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে গিয়ে কখনো কখনো বেঁটে হওয়ার কারণ হতে পারে। ভারতে শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর বইয়ের চাপ কমাতে কাজ শুরু হয়েছে অনেক আগেই। অথচ বাংলাদেশে চাপ কমানোর পরিবর্তে যেন দিন দিন শিশুদের ওপর চাপ বাড়ানোই হচ্ছে। অথচ শিশুদের বইয়ের বোঝা কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুবার নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে আছে উচ্চ আদালতের রায়ও। প্রায় তিন বছর আগে এক রায় দিয়ে একটি আইন প্রণয়নের নির্দেশনাও দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
শিক্ষাবিদ ও চিকিৎসকেরা শিশুদের ওপর থেকে বইয়ের বোঝা কমানোর তাগিদ দিয়ে বলেছেন। যেকোনো উপায়ে বইয়ের সংখ্যা কমানো জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদনহীন বই চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আরও সক্রিয় হতে হবে।
*লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট