আফ্রিকার ছাদ আর ম্যান্ডেলা-টুটুর দেশে
দক্ষিণ আফ্রিকা, আফ্রিকার একটি দেশ। উন্নত বিশ্ব যেমন আমেরিকা, কানাডা বা ইউরোপের যেকোনো শহরের মতোই এই দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের রাস্তাঘাট, বিল্ডিং—সবকিছু এত সাজানো–গোছানো, এত সুন্দর যে এটা আফ্রিকার শহর সেটা বিশ্বাস করাই কঠিন। আফ্রিকা বলতে আমরা বুঝি জরাজীর্ণ ঘরবাড়ি, অনুন্নত রাস্তাঘাট, আশপাশে গরিব মানুষ। পুরো আফ্রিকাতেও তা–ই। আমার বিভিন্ন জায়গা দেখার সুযোগ হয়েছে, সেগুলো মোটামুটি একই রকম। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন, এখানে রয়েছে ৫০ তলা বিল্ডিং, যেটাকে আফ্রিকার ছাদ বলা হয়। আফ্রিকার সবচেয়ে উঁচু ভবনটা জোহানেসবার্গ শহরে অবস্থিত। শুধু বিল্ডিং নয়, রয়েছে সুপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, নিরাপত্তা ও চমৎকার পরিবেশ।
আফ্রিকার ছিল একজন কিংবদন্তি অবিসংবাদিত নেতা। দীর্ঘকাল কারাগারে ছিলেন। ১৯৮০ সালের দিকে মানুষ ভাবতে শুরু করেন যে তিনি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন মানুষ, এমনকি তিন মিনিট নীরবতাও পালন করেন। মানুষের হৃদয়জয়ী মানুষটিই ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। পূর্ণ নাম নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা। ডাকনাম রোলিহ্লাহ্লার অর্থ হলো ‘গাছের ডাল ভাঙে যে’, অর্থাৎ দুষ্টু ছেলে।
নেলসন ম্যান্ডেলা এমন একজন নেতা, যাঁর জীবনের শুরুটা হয়েছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সাদা-কালোর বৈষম্য দূর করার চিন্তা নিয়ে। পরে তিনি মনে করছেন, অন্যায় (যুদ্ধকে তিনি অন্যায় মনে করতেন) দিয়েই যদি অন্যায় শেষ করতে হয়, তাহলে কাজের কাজ তো কিছুই হলো না। এ ধারণা থেকে তিনি সরে আসেন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের ফিলোসফিতে। তিনি তাঁর মতো করে সংগ্রাম চালিয়ে যান, যার জন্যই তাঁকে সুদীর্ঘ সময় জেলেও থাকতে হয়েছিল। এতে জনপ্রিয়তা বহু গুণে বেড়ে যায়।
ম্যান্ডেলার শহরে
ম্যান্ডেলার ভাষণগুলো ছিল অসাধারণ, শুধু কথা দ্বারা কীভাবে মানুষের মনে পৌঁছানো যায়, হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া যায়, সেটা উনার ভাষণগুলো শুনলেই বোঝা যায়। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে আমরা যেভাবে আমাদের স্বাধীনতার, মুক্তির আকুতি পাই; তাঁর ভাষণগুলোও ছিল সে রকম। ভাষণে সাধারণ মানুষের মধ্যে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তার একটা দূরদর্শিতা বলা যেতে পারে।
নেলসন ম্যান্ডেলা যখন জেল থেকে বের হয়ে আসছিলেন, সেদিন সবাই রাস্তার পাশে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি জনগণের ভালোবাসা অনুভব করছিলেন ও স্বাগত জানাচ্ছিলেন। একটি স্কুলের বাচ্চারা ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে আছে দেখে তিনি বললেন, বাচ্চারা এখানে কী করে। ওরা তো এখন লেখাপড়া করবে। ওরা যদি এই বয়সে রাজনীতি বা সামাজিক কাজকর্মে নিয়োজিত থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে দেশ চালাবে কারা? কারণ, তাঁর ধারণা ছিল যে সুশিক্ষিত সমাজই শান্তির একটি দেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
নেলসন ম্যান্ডেলার কাজের সবচেয়ে বড় দিক ছিল তিনি বর্ণবৈষম্যকে সমূলে উপড়ে ফেলতে সক্ষম হন, যেটা সে সময় সবচেয়ে ভয়াবহ মাত্রায় ছিল। সাদা-কালোর বৈষম্যের করুণ অধ্যায়ের যখন সমাপ্তি ঘটল এবং কালো রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাদারা ম্যান্ডেলাকে মেনেও নিয়েছিলেন; সে সময় অনেক সাদাই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল আবার অনেকে নিজেদের প্রাচীন আবাসস্থল হিসেবে সেখানেই রয়ে গেল। যারা রয়ে গেল, তাদের ওপর কালোরা পূর্বের অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উঠেপড়ে লেগে গেল। কিন্তু তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা আর বুদ্ধির কারণে তিনি এই সংঘাতগুলো রুখতে পারেন এবং কালোদের এটা বোঝাতে সক্ষম হন যে অত্যাচারের বদলা যদি অত্যাচার হয়, তাহলে আমাদের আর তাদের মধ্যে কোনো তফাত থাকবে না। তাঁর আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল। রাষ্ট্রপতি হয়ে ২৭ বছর আগে তাঁকে কারাবন্দী করা ডি ক্লার্ককে নিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিলেন। যেটা গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। এ রকম মহান একজন নেতা, যিনি কিনা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পরও স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেশটিকে একটি স্থায়ী শান্তির দেশ বানানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এবং ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অবদান রাখার জন্য নেলসন ম্যান্ডেলাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তিনি তাঁর গোত্রের নিকট মাদিবা (যার অর্থ জাতির জনক) নামে পরিচিত।
এক দেশে দুই গুণী
একই দেশে আরেকজন লোক হচ্ছেন ডেসমন্ড টুটু বা ডেসমন্ড পিলো টুটু। যিনি দক্ষিণ আফ্রিকার একজন ধর্মযাজক ও অধিকার আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। দারিদ্র্য, বর্ণবাদবিরোধী প্রচারণায় তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয় এবং যক্ষ্মা ও এইডস প্রতিরোধে তিনি অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখছেন। তিনিও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ছিলেন।
এই দুজনের মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল আছে। দুজনই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী, দুজনই একই দেশের, একই শহরের, একই রাস্তায় বসতি। রাস্তার এই পাশে একজনের বাসা, অন্য পাশে আরেকজনের। মধ্যবর্তী দূরত্ব ২০০ গজের মতো। এ রকম মহান দুজন নেতা যে এলাকায় জন্ম নিয়েছেন, সেটা দক্ষিণ আফ্রিকার একটি গরিব এলাকা। ডেসমন্ড টুটুর বাড়িটা জোহানেসবার্গে এখনো আছে। যদিও তিনি এখন কেপটাউন শহরে থাকেন।
আর ম্যান্ডেলার মূলত দুটি বাড়ি। একটা তার বাবার বাড়ি, যেটা ডেসমন্ড টুটুর বাড়ির কাছে, যেখানে তিনি বড় হয়েছেন, যেটা তার আদি বাড়ি। আর পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে তিনি জোহানেসবার্গের আরেকটি অভিজাত এলাকায় ছিলেন এবং সেখানে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমার কাছে মনে হয়, উনারা শুধু নেতাই নন, সত্যিকারের ভালো মানুষ, যাঁরা কিনা মানুষের শান্তির জন্য কাজ করে গেছেন, যেখানে উনারা অনেকটাই সফল ছিলেন।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এমন মহান দুজন নেতার বাড়ি এবং শহর ঘুরে দেখার। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম যে একই রাস্তায় দুজন নোবেল বিজয়ীর জন্ম, যেখানে নিজেদের মধ্যে কোনো পারিবারিক সম্পর্কও নেই। উনাদের বাড়িতে তেমন কিছু না থাকলেও আশপাশে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে দ্বিধা বোধ করেনি, সাক্ষী হতে চেয়েছি উনাদের আবাসস্থল এবং শহর ঘুরে দেখার।
দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে আমার একটি ভুল ভাঙে। সেটা হলো নিরাপত্তা নিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে, এখানে নিরাপত্তার বিরাট অভাব। সন্ধ্যার পর বের হলে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি হয়ে থাকে। যদিও সেটা মিথ্যা নয়, কিন্তু যতটা রটানো হয়েছে তেমনটা নয়। আমাদের ঢাকা বা বিশ্বের বড় শহরগুলোতে যেমন এগুলো হয়, এখানেও তেমন। এর বাহিরে বেশি কিছু নয়। যেহেতু সেখানে ধনী–দরিদ্রের বিশাল গ্যাপ এখনো রয়ে গেছে, এদের পার্থক্যটা অনেক বেশি। অনেকে বড় লোক, আবার অনেকে অনেক গরিব। নিরাপত্তাটা মাথায় রেখে যদি সাবধানে চলাফেরা করা যায়, তবে জোহানেসবার্গ একটা চমৎকার শহর হতে পারে।
আমি সেখানে দিনে ঘুরে বেড়িয়েছি, গাড়ি ভাড়া করেছি। আমি সেখানে একাই ঘুরেছি। বাস, ট্রেনসহ বিভিন্ন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ঘুরেছি। শহরের গাছগুলো ছিল অসম্ভব সুন্দর। আমরা বলিউডের সিনেমাগুলোতে রোমান্টিক দৃশ্যে যে গাছগুলো দেখি, অনেকটা সেগুলোর মতোই।
কেপটাউনে কেব্ল কার
দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে পরিচিত শহর হচ্ছে কেপটাউন, যেটি সমুদ্রের পাড়ে অবস্থিত। এটা ইউরোপের যেকোনো উন্নত শহরের সমতুল্য। আটলান্টিকের বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ে শহরের পায়ের কাছে। এই শহরের সমুদ্রের কাছেই রয়েছে বড় বড় পাহাড়। সেখানে সবচেয়ে বড় পাহাড় হলো টেবল মাউন্টেন। এর চূড়া তিন কিলোমিটার পূর্ব–পশ্চিমে সমান্তরাল। এক হাজার ফুট উঁচুতে পাহাড়। সেখান থেকে একপলকে পুরো শহর আর বিশাল সমুদ্রের দেখা মেলে। এই পাহাড়ে ওঠার একমাত্র রাস্তা হলো কেব্ল কার।
ওপরে ওঠার সময় ঘুরতে থাকে কেব্ল কার, যার ফলে সেটার ভেতর থেকেই জায়গায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় পুরো সৌন্দর্য। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর ভিন্ন এক অনুভূতি পাওয়া যায়। একে তো দূর সমুদ্র, সঙ্গে হালকা ঠান্ডা, বাতাস এবং পায়ের নিচে পুরো শহর। পুরো শহর চোখের সামনে একসঙ্গে ভেসে ওঠে, ঘরবাড়ি আর মানুষগুলোকে অনেক ছোট দেখা যায়। এর মধ্যে খরগোশের আকৃতির বড় ইঁদুরের মতো কতগুলো প্রাণীর দেখা পাই, যারা ক্যামেরা দেখে নিজেদের মতো পোজ দিতে কাছে আসছে। খাবার খাচ্ছে মানুষের কাছ থেকে। বলা যেতে পারে, অনেকটা মিশুক ধরনের। এগুলোর প্রচলিত নাম ডাসি (DASSIE)।
ওপর থেকে নীল সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করা সত্যি অন্য রকম অনুভূতি। সেখানে মানুষের কাজকর্ম দেখলেও অনেকটা পিলে টাইট হওয়ার মতো। সামনে পাহাড়ের গভীর খাদ, সেখানে কিনারায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত, যেখান থেকে একটু পা পিছলালেই মৃত্যু অবধারিত।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি