সরকারিকাজে 'নাগরিক সম্পৃক্ততা' কতটা জরুরি
আরেকটি বিজয় দিবস উদ্যাপন হয়ে গেল। উন্নয়ন বয়ানে বাংলাদেশকে এখন ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ বলা হচ্ছে। এখন চারদিকে তাকালেই রাস্তাঘাট, ওভার ব্রিজের কাজ আর কান পাতলেই উন্নয়নের কথা শুনতে পাই। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশ শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে।
দেশের গ্রামবাংলাকে উন্নয়ন পরিকল্পনায় না নিলে, সরকারের এই দ্রুত মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর লক্ষ্য কোনোভাবেই পূরণ সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে গবেষণার কাজে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার অভিজ্ঞতায় দেখি যে গ্রামগঞ্জে প্রচুর রাস্তাঘাট, ব্রিজ, স্কুল, কলেজ নির্মাণ হচ্ছে। বেশির ভাগ রাস্তাঘাট ও প্রাইমারি স্কুল নির্মাণের কাজ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এই বিপুল উন্নয়নকাজ তদারকি ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য এলজিইডির উপজেলা থেকে শুরু করে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত নিজস্ব কয়েক ধাপের তদারকি টিম কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে জনবল সংকট এবং ব্যক্তিবিশেষে দুর্নীতি সর্ষের মধ্যে ভূত হিসেবে কাজ করছে। আবার যাঁরা স্বচ্ছভাবে কাজ করেন, তাঁদের পক্ষেও বাস্তবিক অর্থে সাইটে গিয়ে ২৪ ঘণ্টা তদারকি করা সম্ভব হয় না। এর পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জনগণের টাকার কাজে জনগণকে কেন্দ্রে রেখেও কোনো পরিকল্পনা আমরা দেখতে পাই না। বরং উন্নয়নকাজের প্রায় সবকিছুই টেকনিক্যাল ব্যাপার, যা গ্রামের সাধারণ অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত কৃষক, শ্রমিক, গৃহিণীদের বোঝার ব্যাপার নয় বলে তাঁদের অনেক ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যাওয়া হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত বহু ধাপের নিজস্ব মনিটরিং প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন সামনে আসে এবং ফলাফল হিসেবে প্রায়ই সংবাদপত্র কিংবা টিভির খবরে রাস্তার কাজে ‘রডের বদলে বাঁশ’ কিংবা রাস্তায় পিচ করার পরেই পিচ উঠে যাওয়ার মতো খবর পাই।
এ বাস্তবতায় সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের, সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) উদ্যোগে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) বাংলাদেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি উপজেলায় এক বছর ধরে পরীক্ষামূলকভাবে সরকারি ক্রয়কাজের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের বিভিন্নভাবে তদারকিতে সম্পৃক্ত করার মধ্যে দিয়ে কাজের মান যাচাই করে দেখছে। এখন পর্যন্ত হওয়া গবেষণার সারমর্ম হচ্ছে, টেকসই উন্নয়নের জন্য কাজের মান বাড়াতেই হবে আর ‘বিনা পয়সায়’ কাজের মান বাড়াতে হলে, ‘জনগণের টাকার’ কাজে, ‘জনগণের বাড়ির পাশের’ কাজে সেই সাইটের আশপাশের মানুষকে কাজের মান যাচাইয়ে সম্পৃক্ত করার কোনো বিকল্প নেই।
জনগণ তাঁর বাড়ির পাশের রাস্তা, স্কুল, ব্রিজ ইত্যাদির ভালোমন্দ কাজের যাচাই করে দেখতে চান। কিন্তু তাঁরা তথ্যের অভাবে দেখতে পারেন না, তাঁরা চান নির্মাণকাজের ভালোমন্দ সম্পর্কে বোঝার প্রাথমিক জ্ঞান। বিআইজিডি তাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছে, যে রাস্তা বা স্কুলের নির্মাণকাজ হবে, সেই কাজ শুরুর দিনই যদি সেই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী কাজ দেখাশোনার একেবারে প্রাথমিক বিষয়গুলো সাইটের আশপাশের মানুষকে একটা উন্মুক্ত বৈঠকে জানান এবং সাধারণ কিছু তথ্য যুক্ত করেন, জরুরি যোগাযোগ নম্বরসহ একটা সাইনবোর্ড সাইটের পাশে স্থাপন করেন, তাহলে মানুষের মধ্যে কাজের মান যাচাই করার উৎসাহ বেড়ে যায়। যেকোনো অভিযোগে কর্তৃপক্ষকে জানানোর আগ্রহও তৈরি হয় মানুষের। গ্রামীণ জনগণের অনেকের হাতে এখন ক্যামেরা ফোন থাকায় শুধু মৌখিক অভিযোগ জানানোই নয় বরং অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে অনেকেই ছবি কিংবা ভিডিও করে রাখছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিচ্ছেন এবং অভিযোগ জানানোর পর শেষ পর্যন্ত কী ব্যাবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটার দিকেও তাঁরা খেয়াল রাখছেন।
এ ছাড়াও, সরকারি সংস্থার পাশাপাশি জনগণের ‘নিজেদের কাজ, নিজেরা বুঝে নেওয়া’ জরুরি। কারণ, সরকারি সংস্থা যেখানে মনিটরিংয়ের সুযোগ পায় মাত্র ৮ ঘণ্টা, সেখানে সাইটের আশপাশের মানুষের কাজ দেখার সুযোগ থাকে ২৪ ঘণ্টাই। কেউই হয়তো ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করতে পারেন না, কিন্তু এখন প্রকৌশলীর কাছে কাজের ভালোমন্দ বোঝার প্রাথমিক জ্ঞান পাওয়ার পর যে যখন সুযোগ পান, তখনই চোখ রাখেন কাজের ভালমন্দে। কোথাও কৃষক সারা দিন মাঠে কাজ করে বিকেলে হাটে যাওয়ার সময় রাস্তার কাজ দেখছেন, কোথাও নারীরা রাস্তার পাশে গরু–ছাগলকে খাবার দিতে দিতেই কিংবা বাচ্চাকে স্কুলে আনা–নেওয়ার সময়ই রাস্তার ঢালাইয়ে ইট, সিমেন্ট বালুর মিশ্রণের অনুপাত চেক করছেন। কোথাও অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবী দল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে যাওয়া ও আসার সময় সাইটের কাজের ভালোমন্দ দেখছেন এবং কাজে ফাঁকি না দেওয়ার জন্য ঠিকাদারকে সতর্ক করছেন। এভাবেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় গ্রামবাংলার নারী–পুরুষনির্বিশেষে কৃষক, শ্রমিক, গৃহিণী, ছাত্র সবাই এখন নিজেদের কাজ, নিজেরা বুঝে নেওয়া শুরু করেছেন। মানুষ শুধু তথ্য চান, শিখতে চান, যে সাইটে কাজ ওই সাইটের পাশের মানুষকে যদি কাজের ভালোমন্দ বোঝার প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়া যায়, তাহলে সেই উন্নয়নকাজের বাস্তবায়নের সময় সাইটভিত্তিক নাগরিক মনিটরিং হচ্ছে। এতে নিশ্চিতভাবেই সরকারি কাজ বাস্তবায়নকারী সংস্থার কাজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ছে।
সব মিলিয়ে যা দাঁড়ায় তাতে সরকারকে নাগরিকদের সাইটভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্পের তথ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণের এই যে সরকারি কাজের মান বুঝে নিতে চাওয়া, এটার এখন পর্যন্ত কোনো আইনি ভিত্তি নেই এবং এই আইনগত ভিত্তি ছাড়া দীর্ঘদিন প্রকৌশলীদের দিয়ে জনগণকে সরকারিকাজ দেখাশোনা সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান প্রদান কিংবা জনগণের বিভিন্ন অভিযোগ আমলে নিয়ে সব সময় ঠিকাদারদের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণের আশা করাটা বাস্তবসম্মত নয়। তাই জনগণের অর্থে জনগণের জন্যে যে উন্নয়ন, সেটাকে টেকসই করতে হলে এই দেশের বিশাল নাগরিক সমাজকে সরকারি কাজ দেখাশোনায় আইনগতভাবে সম্পৃক্ত করার জন্য সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।
মো. মাহান উল হক, গবেষক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]