মেঘালয়ে মেঘ, রোদ ও বৃষ্টির খেলা
শিলং-চেরাপুঞ্জি সেজেছে উঁচু পাহাড়, ঝরনা আর সবুজ প্রকৃতির অপরূপ মেলবন্ধনে। সেখানে রোদ, বৃষ্টি ও মেঘের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন অনায়াসে। আকাশের ঘন নীলের ফাঁকে উড়ে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। সিলেটের তামাবিল সীমান্ত পেরোলেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। ইউরোপীয় শাসকেরা একে প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড বলতেন।
মেঘের সঙ্গে সময় কাটাতে অনেকেই মেঘালয়ের শিলং, চেরাপুঞ্জি ও ডাউকি ঘুরতে যান। তামাবিলে ভিসার কাজ শেষ করে ঢুকে পড়তে হয় ভারতে। ভারতের সীমান্তের শুরু ডাউকি। ভিসার কাজ শেষে শিলংয়ের উদ্দেশে রওনা দিই। এখান থেকে শিলং-চেরাপুঞ্জির আঁকাবাঁকা পথে ঘুরতে ঘুরতে অভিভূত হই আমরা।
সম্প্রতি সপ্তাহখানেক ছুটি থাকায় প্রায় চার-পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশি ভ্রমণপিয়াসি সীমান্তে জড়ো হয়েছিলেন। সেদিন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছিল। তামাবিল বা ডাউকিতে যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া প্রায় সব সীমান্তে বহির্গমন ও শুল্ক বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের বায়না মেটানো ছাড়া পাসপোর্ট বের করে আনা যে দুঃসাধ্য, তা ভুক্তভোগী সবাই জানেন। কাজেই ঝাড়া চার ঘণ্টার বেশি বৃষ্টিতে ভিজে তামাবিল পার হয়ে ডাউকিতে আসি। সেখানকার অব্যবস্থা আরও ভীতিকর। মাত্র দুজন কর্মকর্তা তাল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। মনে হলো তাঁরা এই কাজে নতুন ও অনভিজ্ঞ।
বিমানবন্দর ছাড়া অন্য সব সীমান্তে সরাসরি বা নানা ছুতোয় পকেট কাটতে বাংলাদেশ ও ভারতীয় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস হাত পাকা করে ফেলেছে। অধিকাংশ যাত্রী তো সীমান্তে অনুসৃত আইন জানেন না। আর এই সুযোগটাই নেন তাঁরা। বাংলাদেশের লোকেরা এখনো সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়ানোর অভ্যাস রপ্ত করেননি। সেই মানসিকতাও গড়ে ওঠেনি। ফলে কাকে ল্যাঙ মেরে কার আগে পাসপোর্ট বের করতে পারা যায়, তার জন্য দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যায়। এতে কর্মকর্তারাও দিশা হারিয়ে ফেলেন। পাসপোর্টের সিরিয়াল ঠিক রাখা তাঁদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে আমাদের পাসপোর্ট উদ্ধার হতে বেলা প্রায় তিনটা। অবশেষে তামাবিল ও ডাউকি সীমান্তে ভিসার কাজ সম্পন্ন করে আমরা চার বন্ধু রওনা হই শিলং-চেরাপুঞ্জির উদ্দেশে।
রাস্তায় যাত্রার শুরুতে দিন ও রাতের সব ধকল, কষ্ট ও বিড়ম্বনা এক মুহূর্তে উবে যায়। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে পাহাড়ের পর পাহাড়, তাতে আটকে আছে মেঘের পরে মেঘ, আর শ্যামলী নিসর্গের অফুরন্ত ভান্ডার। আমি মুগ্ধ চোখে পাতা না ফেলে কেবল চেয়েই থাকি এবং ছবির পর ছবি তুলতে থাকি। অবিরাম একই দৃশ্যে ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক। কিন্তু এখানকার দৃশ্য মুহূর্তে মুহূর্তে পাল্টে যায়। নিসর্গের প্রেক্ষাপটে অদৃশ্য কুশীলবেরা যেন নীরবে নব নব সাজে প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে চলে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি নিয়ে ছুটে চলেছেন চালক। আকাশ পরিষ্কার, যেদিকে তাকাই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। চলতে পথে হঠাৎই মেঘের হানা। সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। অবশেষে পৌঁছাই কাঙ্ক্ষিত শিলংয়ে।
শিলং থেকে সকাল সাতটায় বিভিন্ন স্পটে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হই। এখানে আছে দর্শনীয় স্থান। জেনে নেওয়া যাক সেগুলো—
মওলননোঙ্গ ভিলেজ
গ্রামটি এশিয়ার পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে পুরস্কারপ্রাপ্ত। লিভিং রুট, ব্রিজ, জলপ্রপাত ও কিছু বিস্ময়কর হাঁটার রাস্তাসহ মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক আকর্ষণের জন্য জায়গাটি বিখ্যাত। রাজধানী থেকে এর দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার। জীবন্ত শেকড়ের তৈরি লিভিং রুট ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার অনুভূতি যেকোনো মানুষের জন্য স্মরণীয় মুহূর্ত হিসেবে স্মৃতির পাতায় লেখা থাকবে।
উমিয়া লেক
স্কটল্যান্ডের হ্রদের সঙ্গে এই লেকের তুলনা করা হয়। রাজধানী থেকে বেশ খানিকটা দূরে হলেও ছবির মতো সুন্দর ও প্রশান্ত জায়গায় বসে নির্বিঘ্নে কিছুটা সময় অতিবাহিত করার জন্য এই হ্রদ উপযুক্ত জায়গা।
এলিফেন্ট জলপ্রপাত
বহু বছর আগে এক প্রবল ভূমিকম্পে ধসে পড়ে একটি পাথর। আকৃতিতে পাথরটি দেখতে অনেকটা হাতির মতো। বিশাল এই পাথরের কাছেই জলপ্রপাতটির অবস্থান। সুতরাং পাথরের নামেই এর নাম। জলপ্রপাতটির তিনটি ধাপ রয়েছে, মাঝের ধাপটি সর্বাধিক আকর্ষণীয়। চাইলেই যেকোনো পর্যটক নিচে নেমে ঝরনাটি দেখতে পারবেন। এ জন্য অবশ্য তাঁকে অনেক ধাপ বেয়ে নামতে হবে। জল পড়ার শব্দ আর বাতাসে তার শীতল স্পর্শ আপনার মন মাতিয়ে দেবে।
শিলং ভিউপয়েন্ট বা পার্ক
শিলং ভ্রমণে গেলে এখানকার সর্বোচ্চ জায়গাগুলো পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই রোমাঞ্চকর। এখানকার টিলা ও উপত্যকাগুলো বেশ মনোরম আর সর্বক্ষণ যে বাতাস বয়, তা কেবলই নির্মল বা বিশুদ্ধ।
গলফ লিঙ্ক ও অয়ার্ডস লেক
ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত গলফ কোর্সটি ঘুরে দেখার মতো একটি জায়গা। পাইনগাছে ঘেরা কোর্সটি যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে আপনার জন্যই অপেক্ষা করে আছে। পাশেই রয়েছে একটি জলপ্রপাত, যা স্থানীয় লোকজনের যাতায়াতের পথেই পড়ে। এখান থেকেই হাঁটা দূরত্বে রাজহাঁসের সঙ্গে সময় কাটানো এবং বোটিংয়ের জন্য চমৎকার একটি জায়গা অয়ার্ডস লেক।
অল সেন্টস চার্চ
এক শ বছরের বেশি পুরোনো ভবনটি অল সেন্টস ক্যাথেড্রাল নামে পরিচিত। শুধু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরাই নন, পর্যটকেরাও এখানে উপস্থিত হন এর ইতিহাস ও স্থাপত্যের সাক্ষী হতে।
লেডি উদ্যান
ছোট পুকুরের সমন্বয়ে জাপানি শৈলীতে সাজানো উদ্যানটি যেন এক টুকরা স্বর্গ। উদ্যানের ভেতর চিড়িয়াখানাও রয়েছে। এ ছাড়া আছে একটি জাদুঘর, যেখানে পাইথনের চামড়া, চিতাবাঘ, হাতির মাথার খুলি ও বিরল প্রজাতির প্রাণীর ছবি এবং নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। আরও দর্শনীয় স্থান আছে, যা দেখে আপনার অসম্ভব ভালো লাগবে।
এ ছাড়া মেঘালয় রাজ্যটি পাহাড়ের ওপর হওয়ায় এখানে মেঘ, রোদ ও বৃষ্টির খেলা চলে। মেঘের পরিবর্তন হয় ঘন ঘন। মেঘালয়ে রোদ ও বৃষ্টির চেয়ে মেঘের খেলা চলে বেশি। আমরা মূলত মেঘের কারণে অনেক সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাইনি। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে শিলং-চেরাপুঞ্জিতে আসলে যে কারও মন অবশ্যই ভরে যাবে, দূর হয়ে যাবে ক্লান্তি। পাহাড়, ঝরনা এবং টিপটপ সাজানো শিলং শহরটি বারবার দেখতে ইচ্ছে করবে।
শিলং ও চেরাপুঞ্জিতে বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো বাহন ট্যাক্সি। তবে বড় দল হলে শিলং থেকে বাস ভাড়া করেও চেরাপুঞ্জি যাওয়া যাবে। তবে সীমান্ত পার হওয়ার পর বেনাপোল কিংবা চেংড়াবান্ধার মতো মুদ্রাবিনিময়ের সুযোগ কিন্তু সীমিত। এমনকি শিলংয়ের মতো শহরেও ডলার ভাঙানো সহজ নয়, টাকা ভাঙানো প্রায় অসম্ভব। তাই প্রাথমিক ঘোরাফেরার জন্য যত দূর সম্ভব সীমান্ত এলাকাতেই বেশ কিছু ডলার ভাঙিয়ে নেওয়া ভালো। এরপর শিলংয়ে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় ডলার ভাঙাতে পারবেন। শিলংয়ে সারা বছর মনোরম আবহাওয়া মেলে। গ্রীষ্মে হালকা উলের পোশাক ও শীতে ভারী গরম জামাকাপড়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বৃষ্টি এ অঞ্চলে যখন-তখন হতে পারে। সুতরাং শিলং ভ্রমণের জন্য ছাতা আর রেইন কোট ও রাবারের জুতা অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে। বেড়ানো শেষে কেনাকাটা করতে হলে শিলংয়ের পুলিশ বাজারের দোকানগুলো ভালো।
পুলিশ বাজার হচ্ছে শিলংয়ের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানকার বেশ কিছু দোকান বর্তমানে প্রতীকী মর্যাদা অর্জন করেছে। যেমন, দিল্লি মিষ্টান্ন ভান্ডার। অনেকেই বলেন, এখানকার জিলাপি না খেলে আপনার মেঘালয় ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিক্রেতারা ডামপ্লিং, সেদ্ধ ডিম ও ঠোঙ্গায় মোড়া দারুণ স্বাদের ভুট্টা ভাজা বিক্রি করেন। শীতল হাওয়ায় এসব স্ন্যাক্সের জুড়ি নেই।
থাকার জন্য সামর্থ্যের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মানের হোটেল। পাইথন সুইটস হোটেল, হোটেল নাইট ইন, হোটেল সেন্টার পয়েন্ট, চেরাপুঞ্জি হলিডে রিসোর্ট, হোটেল আলপাইন কন্টিনেন্টাল হল এবং শিলং ক্লাব গেস্টহাউসগুলো অধিক পরিচিত। হোটেল পোলো টাওয়ার্স এখানকার একমাত্র চার তারকা হোটেল। তবে সেখানে থাকার মতো বেশি হোটেল এখনো গড়ে ওঠেনি, ফলে আগে থেকে হোটেল বুকিং নিশ্চিত করতে হবে। শিলংয়ে ভালো মানের হোটেলের ভাড়া দিনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ থেকে ২০০০ রুপি। এর কম-বেশিও আছে।