২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

কাচ্চি বিরিয়ানি বনাম আলুভর্তা

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

‘তোমার সাহস তো কম না, চেহারা দেখছ নিজের?’

পাভেল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘কেন, খারাপ কী? ভালোই তো আছে...’

‘ভালো তো বটেই, আলুভর্তা যাদের ভাল্লাগে, তাদের ভালোই লাগবে! তোমার থোবড়াটাও ওই টাইপ! শুধু আলুভর্তা না, গামলাভরা আলুভর্তা !’

রুনকি রাগ দেখিয়ে হাসি চাপছে। পাভেল গোমড়ামুখে তাকিয়ে আছে। প্রেমিকাকে হ্যালভেসিয়ায় এনে হাজারো টাকার ওপরে খরচের পর যদি শোনে তার চেহারা আলুভর্তা মার্কা, তখন কেমন লাগে?

রুনকি টিস্যু পেপারে সাবধানে ঠোঁট আর হাত মুছে উঠতে উঠতে বলল, ‘এভাবে বুঝছ তো আমার পেছনে ঘুরে লাভ নাই, কয় বছর ভার্সিটিতে যা হওয়ার হইসে, এখন ভুলে যাও, আমার ইন্টারেস্ট চলে গেছে!’

‘সবই বুঝবার লাগচি! তুমি আসলে ওই চিকনা সুরতের আকাশের পিচনে টাইম খারাপ করতাচ, আমারে ছাইড়া হেরে বফ বানাইচো, সব জানি! তয় কইলাম লাভ নাইক্কা ওই হালায়....’

পাভেলকে থামিয়ে রুনকি মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, ‘আমার লাভ-লোকসান ভেবে তোমার কাজ নেই। আর শোনো, সে আমার বফও না। তুমি আমার টাইমপাস ছিলা, সে আমার “জাস্ট ফ্রেন্ড”! আর আমার জাস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার জন্যও যোগ্যতা লাগে। সে তোমার টাইপ আলুভর্তা মার্কা না, ক্লাসি পিৎজা বার্গার মার্কা, বুঝছ?’ রুনকি উঠে হাঁটা শুরু করল।

‘কী যুগ্যতা লাগব আমারে কও! আমি হালায় সব করুম! তবু রুনকি আমারেভি জাস্ট ফেরেন্ড বানায় লাও! আল্লাহর কিরা লাগে, এমন কইরো না, তুমি আমার জানের জান...’

পাভেলের কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে বিরক্ত রুনকি দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল, ‘পাভেল পা ছাড়ো! আলুবাজারের আড়তের মালিকের জানের জান আমি হতে চাই না।’

‘রুনকি পিলিজ লাগে, আমি হালায় সত্যি লাভ করি তুমারে...’ পাভেল হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে।

আশপাশের টেবিলের লোকেরা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে।

‘উঠো পাভেল! প্লিজ সিনক্রিয়েট করবা না...’

‘তার আগে কও তুমি কি করলে ফিরা আইবা...’

রুনকি দেখল এ তো আচ্ছা নাছোড়বান্দা, ‘উফ রে, তুমি সবকিছু করতে পারবা আমার জন্য?’

‘তুমি সুধধু হুকুম করবা, দেখো আমি কী করবার পারি, মাগার জানটা খালি দিবার পারমু না!’

‘আচ্ছা যাও প্রতিদিন বিকাল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত আমার বাড়ির সামনে দাঁড়ায় থাকবা মিনিমাম ছয় মাস, তাহলে বুঝব তুমি আসলেই আমায় ভালোবাসো...রাজি?’

‘আরে আমি মর্দকা বাচ্চা, রাজি মাইনে! তুমি এখন দেখবা দেওয়ানা কারে কয়। তুমারে না পটায়া ছাড়ুম না!’

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

২.
কিছুদিন পরের দৃশ্যপট,
রুনকির বাসার রাস্তার উল্টো দিক চায়ের দোকানের সামনে। সেখানে এখন প্রতিদিনই একটা বিশাল প্রাডো থামে সেখান থেকে ঠাটবাটের রঙ্গিলা পোশাকের এক হৃষ্টপুষ্ট যুবক বের হয়, এরপর একাধারে রুনকির বাড়ির জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। রুনকি এলাকার ডাকসাইটে সুন্দরী, তার অনুরাগীর অভাব নেই। আরেকজন নতুন পাগলের আমদানি। যুবকের অপেক্ষা যে সব সময় নির্বিঘ্ন হয়, তা নয়। মাঝেমধ্যে পাড়ার বড় ভাইয়ের তাড়া খায়, মাঝেমধ্যে টহল পুলিশের জেরা, কখনো বড় মুরব্বির চোখরাঙানি, তবু পাভেল নির্বিকার।

‘কী বেদ্দব পুলারে আল্লাহ!’

এদিকে যেই ইষ্টদেবীর এত আরাধনা, তার যেন তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার প্লাক করা ভ্রু তুলে নিজের রাজ্যে ঘুরে বেড়ায়। কখনো করুণা হয়, তখন তাকায় তার দিকে। তবে বেশির ভাগ সময় মুখঝামটাই জোটে কপালে। এত কিছুর পরও এই কাঁঠালের আঠা যেন ছোটার নাম নেই। পাভেলের উৎসাহ কমেই না, বিচিত্র এক গোঁয়ার্তুমি পেয়ে বসে আছে।
পাশের দোকানিরও চিন্তা হয়, তার দোকানের চা-সিগারেটের বাঁধা গ্রাহক বলে কথা।

‘ভাইজান বৃষ্টিত ভিজ্জা যাইতাসেন তো, গাড়িত যায়া বহেন’

‘এইডা মোহব্বতের বৃষ্টি, তুমি বুঝবা না!’

‘ও ভাই, দুইন্যার রোদ্দুর, ছাউনিত খাড়ান আইয়া’

‘এইডা মোহাব্বতের রোদ্দুর কালাম মিয়া, তুমি বুঝবা না’
পাভেলের উদাসী উত্তর।

রুনকি তখন আরও জোরে জানালার কপাট লাগায়! তার রুক্ষতা পাভেলের আরও উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়। তবে তার অতি উৎসাহটা একদিন এলাকার এক পাগলা কুকুর ভালো ভাবে নিল না। পাভেলের ভারী বুট জুতায় তার লেজ মাড়িয়ে দিল। অতঃপর কপালে জুটলো কঠিন মোহাব্বতের ঘেউ ঘেউ এবং মোহাব্বতের দৌড়ানি! আর ফাইনালি ওই বেত্তমিজ বেলেহাজ কুকুরটা কামড়েও দিল তো জটিল জায়গায়! কপাল ভালো সময়মতো সেই এলাকার একজন সদ্য পাস করা চিকিৎসক সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। তবে ততক্ষণে দুর্গতির যা হওয়ার হয়ে গেছে। তার সঙ্গে পাভেলের ইজ্জতেরও ফালুদা হয়েছে। এদিকে পাভেল আহত হলো আর ওদিকে রুনকিও কিছুদিনের জন্য হাঁফ ছাড়ল।

৩.
পাভেলের ঘর! বিশাল পালঙ্কে মুখ আমসি করে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আজকাল সোজা শুতেও পারছে না, তার ওপর ইনজেকশনের যন্ত্রণা! এত কষ্টেও পাভেল প্রতিদিন আশায় থাকে এই বুঝি রুনকি এল। আচ্ছা, রুনকি জানে তো তার অবস্থা? হয়তো জানে বলেই আসতে পারছে না লজ্জায়। প্রেমিকের এমন মারাত্মক জায়গায় ঘা দেখতে আসা সমীচীনও নয়। তবে রুনকি না এলেও প্রতিদিন আরেক যন্ত্রণা জুটেছে কপালে।

পাভেলের বড় ভাই পুরান ঢাকার ব্যাবসায়ী রুবেল সাহেব! কাজ সেরে ভাইয়ের ঘরে কথায় কথায় মাঝেমধ্যেই রাগে ফেটে পড়েন, ‘হইচে এইবার! ছাড়ো, মজনুগিরি কইরা মজা পাইচত, তোর টেংরিটা যদি না ভাঙচি আমার নামভি রুবেল ব্যাপারী না....।’

পাভেল সাহেব কেমন আছেন? হঠাৎ রিনরিনে কণ্ঠে চমকে উঠল পাভেল। দরজার মুখে সরল স্নিগ্ধ মুখটা দেখে হঠাৎই আবার আশা ছেড়ে দিল।

৪.
ছোটলোক, জানোয়ার, ইতর—আকাশের ফ্ল্যাট থেকে রুনকি বের হতে হতে তার চৌদ্দ পুরুষের পিণ্ডি চটকাচ্ছে। আকাশকে শামার সঙ্গে আজ হাতেনাতে ধরেছে সে। তাকে দেখে আকাশটার যেন কোনো গিল্টি ফিলিংসই নেই, ‘আরে বেবি, তুমি ব্যস্ত ছিলা... আমরা তো শুধু হ্যাঙাউট করছিলাম, জানো তো শামা অ্যান্ড আই...উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস!’

‘তোর জাস্ট ফ্রেন্ডসের গুষ্টি কিলাই! স্ক্রাউন্ড্রেল ছোটলোক, সান ওফ এ... ... ...!

রুনকির নিজের জন্যই খারাপ লাগছে। আকাশটাকে একটু একটু করে মনে ধরেছিল তার, প্রথমে যদিও গুড টাইমপাস হিসেবে নিয়েছিল...। তবে অনেক দিন পর মনটা থিতু হতে চাইছিল। কিন্তু এখানেও ওই লুইচ্চাই জুটল কপালে। ধ্যাৎ! অনেক হলো এখন তার একটা পার্মানেন্ট ‘পাপি’ দরকার। যে কেয়ারও করবে আবার পয়সা লুটাতেও পিছপা হবে না...।

তবে মায়ের আনা ছাগলা চেহারার পাত্রগুলোর প্রস্তাবেও মন সায় দেয় না। ‘গরু-ছাগলে’র মানুষ সংস্করণ সব; কিন্তু রুনকি তো গরু-ছাগল নয়, গরু-ছাগলের নামে সাইনবোর্ড দরকার। কোথায় মিলবে...? ভাবতে ভাবতে বাড়ির গলিতে ঢুকে গেল রুনকির রিকশা! তাদের বাসার সামনে আবার সেই নীল প্রাডো, আবার সেই পাভেল দাঁড়িয়ে। পাভেলের গাড়িটা লেটেস্ট মডেলের, এদের কিন্তু কাঁচা পয়সা আছে বেশ! পাভেলের কথা ভাবলেই রুনকির হাসি পায়। পাভেলটাকে কুকুরে কামড়েছিল কিছু দিন আগে, তা–ও কঠিন এক জায়গায়। এত কিছুর পরও হ্যাঙলাটা আবার ঘুরঘুর করছে...সেদিন কিছু না ভেবেই শর্তটা দিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু পাভেল দৈববাণীর মতো মেনে চলেছে, একে বলে আদর্শ ‘মজনু’!

আচ্ছা পাভেল তো হতে পারে রুনকির মোক্ষম সাইনবোর্ড! তাদের পয়সার অভাব নেই, রুনকিকে ভালোও বাসে, উপযুক্ত হাতের মুঠোয় থাকা পোষা জামাই! এর মধ্যে ভালো না লাগলে আয়েশের জন্য যে কাউকে ‘টয় বয়’ বানিয়ে নেওয়া যাবে, ক্ষতি কী? পাভেলের মতো গাধাকে সামলানো মুশকিল নাকি? রুনকির চোখ চকচক করে উঠল!

৫.
পাভেল অবাক হয়ে দেখল বাড়ির গেটের কাছে এসেও রুনকি হঠাৎ ঘুরে গেল। রাস্তা পার করে আজ হেঁটে হেঁটে তার কাছে এল। পাভেল কিছুটা বিব্রত, কেমন যেন ধরা খাওয়া চোরচোর দৃষ্টি! রুনকির মজা লাগল, ‘গাধা একটা’। আশেপাশের বাসাবাড়ির ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে দেখছে তাদের। রুনকি এখন পাভেলকে যেই কথা বলবে, পাভেল খুশিতে নাটক জুড়ে দেবে, এটা ৯০ ভাগ নিশ্চিত। রুনকি কাছে এসে মিষ্টি করে হাসল,

‘ভালো আছ পাভেল?’

‘আরে এই তো...তুমি ভালো আচো রুনকি?’

‘না আমি খুব খারাপ আছি! কারণ তুমি জিতে গেছ!’

‘আমি জিতচি মাইনে কিস্যে জিতচি!’

‘শর্তে, আমার হৃদয় জয় করার শর্তে! ছয় মাসের আগেই জিতেছ! কুকুরের কামড় খাওয়ার পরও তুমি এসেছ! আমি সত্যি মুগ্ধ–আপ্লুত, আমিই ভুল বুঝেছিলাম তোমায়...’

‘রুনকি ইয়ে, আসলে ঘটনা হইল গিয়া, তুমি এখনো ভুল বুঝবার লাগছ!’

মানে?

‘মাইনে হইল কুত্তার কামড় খাওনের আগে আমি আইতাম তুমার লাইগাই, তয় কামড় খাইয়া ভাবছি এইবারে তুমি এক্কেরে পইটা যাইবা, তুমারে তো হালায় পটাইবার পারি নাইক্কা, তয় তুমার পাশের বাড়ির চিকিৎসক সুমনা কইলাম পইট্টা গেচে!’

‘সুমনা পটে গেছে! তোমার জন্য!’ রুনকি অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে! রুনকির চোখ ছানাবড়া, সে কি ভুল শুনল?

‘হ ঠিকই হুনচ! নিজে পটচে আমারভি পটায়লাইচে! কয় দিন ধইরা আমি তার লাইগাই আইতেচি, আইজ তো আমার ফ্যামিলিভি আইচে। সামনের মাসের পয়লা জুমা আমগো শাদি মোবারক, বুঝলা নাকি! আইবা কইলাম, কাচ্চি বিরিয়ানির দাওয়াত, তোমার তো আবার আলুভর্তা পছন্দ না!’