মেধা পাচার
এক.
আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতাসহ বিকশিত হওয়ার অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে মেধাবী তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ উন্নত দেশে পাড়ি জমায়। বেড়ে ওঠা আর শিক্ষায় নিজেকে তৈরি অনেকটাই দেশে, অথচ মেধার ব্যবহার বিদেশের মাটিতে। উন্নত দেশের গবেষণা, প্রযুক্তি আর স্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে এই মেধাবীরাই সেসব দেশকে করেন আরও শক্তিশালী, পরাক্রমশালী। পরের তরে নিজেদের বিলিয়ে দেওয়া। সম্ভাবনাময় এই তুখোড় প্রজন্মকে হারিয়ে স্বদেশের উন্নয়নের যাত্রায় ধাক্কা, অগ্রগতিতে বাধা, গতিতে ধীর। এটা মেধা পাচার, ব্রেইন ড্রেইন।
দুই.
মেধাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বকীয়তা অর্জনে ব্যস্ত এমন একটি জাতিকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। জৈব রসায়নে উচ্চতর গবেষণার জন্য জার্মানি যাওয়ার সুযোগটা হাতে পেলেন ড. শিগেকি তাকাই। জাপানি গবেষক। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে পিএইচডি ডিফেন্স শেষ হয়েছে তাঁর। নিজ দেশেই গবেষণা করবেন নাকি পোস্ট ডক্টরাল কাজে জার্মানি পাড়ি দেবেন, তিনি আছেন এই ভাবনা নিয়ে। স্বদেশী সুপারভাইজর অধ্যাপক ওয়াতানাবের কাছে পরামর্শ নিলেন। সিদ্ধান্তšহলো দেশেই কাজ করবেন। জার্মানির পোস্টডকের অফারটা ফিরিয়ে দিলেন।
আরেক তুখোড় গবেষক ড. হামাসাকি। জাপানের কুমামোতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শেষেই ছুটলেন আমেরিকা। রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে দুই বছর কাজ করলেন ক্যালিফোর্নিয়ার সান-দিয়েগোতে। এরপর ফিরলেন তাঁর দেশ জাপানে। টোকিওর এক কোম্পানিতে এক বছর গবেষণা শেষে যোগ দিলেন কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষক ও শিক্ষক তিনি। কাজ করছেন রসায়নে। নিজের ইচ্ছায় আর দেশের জন্য। ধ্যান, জ্ঞান সবকিছু এটাকে ঘিরে। প্রবল আগ্রহ তাতে।
জাপানে দীর্ঘ সাত বছরে পাঁচজন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও রিসার্চ কোম্পানিতে। ড. তাকাই ও ড. হামাসাকির মতো অনেক গবেষকের সঙ্গে একই ল্যাবে কাজ করেছি। মিশেছি ও তাঁদের জেনেছি। উন্নত দেশ জাপান। সব আছে ওখানে। স্বদেশেই উচ্চশিক্ষা নিয়ে সেখানেই কাজ করছেন তাঁরা। বিদেশে গেলেও দেশের টানে ফিরে যান বেশির ভাগ মানুষই। নিজেদের সবটুকু মেধাকে কাজে লাগাচ্ছেন স্বকীয়তা ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে। তাকিয়ে দেখুন, প্রমাণ সবখানে। গবেষণা, নোবেল বিজয়, যোগাযোগ, জীবনমান, নম্রতায়, পরিচ্ছন্নতায়—সবকিছুতে।
অথচ প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছে এই জাতিকে। ভূমিকম্প নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার সেখানে। আরও আছে সুনামি। ফসলের জন্য মাটিও তেমন উর্বর নয়। ২০১১ সালের মহাপ্রলয়ংকারী প্রাকৃতিক বিপর্যয় সেনদাই অঞ্চলের সবকিছু গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সুনামিতে চিরতরে হারিয়ে গেল ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। ভয়াবহ বিস্ফোরণ হলো ফুকুশিমা দাইইচি নিউক্লিয়ার শক্তিতে। ভেসে গেল বাড়ি, গাড়ি—সব। নেতিয়ে পড়া জাপান তবুও উঠে দাঁড়াচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালে ভেঙে পড়া হিরোশিমা আর নাগাসাকিও ঘুরে দাঁড়িয়েছে অনেক আগেই।
অনেক পিএইচডি আর মাস্টার্সের ভিড়ে কানাডায় নিজ কর্মক্ষেত্রে অন্তত তিনজনকে তাঁদের নিজ দেশে ফিরে যেতে দেখলাম। চীন সরকার অনেক সুবিধা দিয়ে এই মেধাবীদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল। নিজ দেশে বসে সেখানকার জন্য কাজ করবেন তাঁরা। ভিন দেশে থেকে বিশ্বায়নে ভূমিকা রেখে জন্মভূমির জন্যও কাজ করা যায়। উত্তর আমেরিকায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই চীন জাতি আর ভারতীয়দের দাপট চোখে পড়ার মতো। গবেষণা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, আইটি—সবখানে। সঙ্গে এগিয়েছে চীন আর ভারতও। আমাদের অবস্থানটা ঠিক কোথায়?
তিন.
বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিরাও খুব পিছিয়ে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালসহ দেশের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের একঝাঁক তুখোড় মেধাবীকে জানি। ভালো বন্ধু ড. জুলিয়াস, ড. জুবায়ের, ড. আনোয়ারসহ অনেকেই আছেন এ দলে। একসময় তাঁরা দেশেই শিক্ষকতা করেছেন অথবা গবেষণার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন কারণে দেশের মায়া কাটিয়ে এখন বিদেশের মাটিকে আঁকড়িয়ে পড়ে আছেন। আমেরিকা ও ইউরোপের বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। তাঁদের কাজ প্রকাশিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শীর্ষ জার্নালগুলোতে, তার একটি হলো নেচার।
শুধু উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপেই নয়। আমাদের মেধাবী তরুণেরা ছড়িয়ে আছেন বিশ্বব্যাপী। জাপান, চীন, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ সব জায়গায়। বিদেশের মাটিতে কাজ করছেন তাঁরা। গবেষণা, আইটি, শিক্ষকতাসহ কত কিছুতে। দেশের নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেলে লেখাপড়া করেছেন তাঁরা। পরিসংখ্যান নেই। তবে বাইরে চলে যাওয়ার এই সারিতে বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি বলেই মনে হয়।
বাংলাদেশে সরকারি অথবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সবখানেই আছেন মেধাবীরা। চোখেমুখে তাঁদের জানার আগ্রহ অপরিসীম। বাংলা মায়ের কোলে বেড়ে ওঠা সজীব তারুণ্যে ভরা এসব মেধাবী শিক্ষায় নিজেদের তৈরি করে অনেকেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। ছাত্রাবস্থায় অথবা কর্মজীবনের শুরুতেই তাঁদের এক বিশাল অংশ বিদেশে যাওয়ার চেষ্টায় থাকেয়। একসময় চলেও যায়। মেধার বিকাশ ঘটাতে গুণগত শিক্ষা আর উন্নত গবেষণার দরকার আছে। তা ছাড়া প্রতিযোগী না থাকলে প্রতিযোগিতা জমে না।
বিশ্বায়নের যুগে তাল মেলাতে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই। তবে তাঁরা যদি দেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যান! ভেবে দেখুন। হারিয়ে যাচ্ছে। মেধাবীরা যদি দেশ থেকে হারিয়ে যান, এটা মেধা পাচার। দেশের মাটিতে বড় হয়ে, সেখানে উচ্চশিক্ষা নিয়ে, পরে শিক্ষকতাসহ প্রথম সারির বিভিন্ন পেশার কর্মক্ষেত্র ছেড়ে বিদেশে গমন। ভিন দেশের উন্নত গবেষণা ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আরও যোগ্য করেন। অনেকেই পারেন, কেউবা নয়। তবু যেন হাল ছাড়া নয়, থিতু হয়ে পড়ে থেকে সেসব দেশে স্থায়ী হয়ে যান। দেশকে নিয়ে ভাবেন, কেউ দেশের জন্যও কাজ করেন।
চার.
উন্নত বিশ্বে শিক্ষা ও গবেষণায় রাজনীতির ভিন্ন ভিন্ন রং নেই। জাতি তৈরির মহান পেশা শিক্ষক হতে হলুদ-বেগুনি দল নয়, যোগ্যতা ও গবেষণার মানই মুখ্য। বিশ্ববিদ্যালয় আর বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষকেরা দিনরাত কাজ করেন আবিষ্কারের নেশায়। শিক্ষা ও গবেষণায় অর্জিত ফসল ছড়িয়ে যাচ্ছে সবার কাছে। কৃষি, শিল্পকারখানা—সব জায়গায়। বিদেশের মাটিতে ওদের সঙ্গে মিশে প্রতিযোগিতায় আমরাও পারি। দেশেও সম্ভব। নিজ জায়গায় স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধের খুব দরকার। রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের জন্য তুখোড় মেধাবীদের সুবিধা দিয়ে দেশের জন্য কাজে লাগাতে হবে। বিশ্বাস করি, সবার মধ্যে দেশপ্রেম আছে। মাকে কেউ ভুলতে পারে না, দেশমাতাকেও নয়। দেশ গঠনে প্রখর বুদ্ধিমত্তায় উজ্জীবিত একটি তারুণ প্রজন্মকে স্বপ্নে দেখি।
*ড. মো. সাদেকুল ইসলাম, পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, টরন্টো, কানাডা।
ই–মেইল: [email protected]