‘তুমি পারলে না কেন?’ আমি প্রথম যখন এ রকম কথা শুনেছিলাম, খুব অবাক হয়েছিলাম। কারণ, কথাটা আমার বাবার মুখ থেকে বের হয়েছিল। আমি তখন ক্লাস টুতে উঠব। ক্লাস ওয়ানের পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। আমি ফার্স্ট হতে পারিনি। সেকেন্ডও হইনি। আমার পজিশন থার্ড কি ফোর্থের দিকে হবে। তাতেই আমার মায়ের চোখ ছলছল করে উঠল। আর বাবা বললেন, ‘তোমার কিসের অভাব রেখেছি? তুমি পারলে না কেন?’ আজ এত বছর পর বিভিন্ন ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছি। এখনো আমাকে এ ধরনের কথার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বড় অবাক লাগে, আমি চেষ্টা করি; কিন্তু আমি কখনোই পুরোপুরি পারি না। কিংবা বলা যায়, আমি হয়তো পারি; কিন্তু সেই পারাটা আমার বাবা-মায়ের খুব মনমতো হয় না।
ওপরের কথাগুলো সবে কৈশোর পার হওয়া একজন তরুণ শিক্ষার্থীর। আমাদের দেশে যেকোনো বয়সী অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে এ রকম অনুভূতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
মনোবিজ্ঞানীরা কী বলেন
‘ও কেন পারে? তুমি কেন পারো না?’—এই জাতীয় কথাগুলো মনোবিজ্ঞানীরা একেবারেই পছন্দ করেন না। তাঁরা বলেন, এর চেয়ে বরং ছোট করে বলা ভালো—‘তুমি পারবে!’ প্রতিনিয়ত অন্যের সঙ্গে তুলনায় আমাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়। এটা তৈরি হতে পারে যেকোনো বয়সের মানুষের মধ্যেই। প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সমবয়সী বা প্রায় সমবয়সীদের সঙ্গে তুলনার ব্যাপারটি চলতে থাকে। এমনকি এই তুলনায় যুক্ত হয় মা–বাবার অফিসের সহকর্মীর ছেলেমেয়েরাও। শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতায় থাকে। তাদের মধ্যেও অন্যের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ চেষ্টা চলতে থাকে। এর ওপরে ‘তুমি কেন পারলে না?’ এ রকম প্রশ্ন তার ক্ষতিই করে বেশি।
অভিভাবকের জায়গা থেকে
শিক্ষার্থীর সফলতা-ব্যর্থতার বিচারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার। তবে মনে রাখতে হবে, এই মূল্যায়ন সব সময় হবে ইতিবাচক। যতটুকু অর্জন করেছে, ততটুকুকে বড় করে প্রশংসা করতে হবে আগে। ভালো ফলাফল আর বড় বিদ্যায়তনে ভর্তি হতে পারা জীবনের চরম লক্ষ্য নয় কখনো। সবাই তো আর বুয়েট, মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না। সফল মানুষদের জীবন ও সাধনা লক্ষ্য করলে প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফলকেই অনেক সময় বিদ্রূপ করতে ইচ্ছা করবে আপনার। সন্তান আপনার; আপনি নিশ্চয় তার ভালোটাই চান। তাহলে ‘ও কেন ওখানে ভর্তি হতে পারল; তুমি কেন পারলে না?’ এত বড় মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী প্রশ্ন নিয়ে সন্তানের মুখোমুখি কেন হবেন?
শিক্ষকের কাজ কী
শিক্ষকেরা অবশ্য এই প্রশ্ন করেন না—‘তুমি কেন ফার্স্ট হতে পারলে না?’ কারণ তিনি অন্তত এটা বোঝেন—একটা ক্লাসে সবাই প্রথম-দ্বিতীয় হবে না। তবে শিক্ষকেরাও ভুল করেন। তাঁরা মনে করেন, এই ছেলেটা ক্লাসে মনোযোগী নয় কেন? ও কেন পরীক্ষায় ফেল করবে? ইত্যাদি। লক্ষ করার ব্যাপার, এখনকার শিক্ষকেরাও শিক্ষাকে কেবল জিপিএ দিয়ে মাপতে চান। তাঁরাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘নাহ্, এই রেজাল্ট দিয়ে ও জীবনে কিচ্ছু করতে পারবে না!’ অথচ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো সূক্ষ্মতর চেতনা ও বৃহৎ মানবিকতার সবগুলো প্রান্তকে খুলে দেওয়া। সহজ করে একে বলা যেতে পারে, ভালো মানুষ করে তোলা। শিক্ষক যদি এই আসল কাজটি না পারেন, তবে অন্তত শিক্ষার্থীকে একাডেমিক পড়াশোনার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সুযোগের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেবেন।
শিক্ষার্থীর জন্য পরামর্শ
সবাই এক রকম হয় না। আর ভবিষ্যতে সবাই একটা পেশাকেই বেছে নেবে না। অতএব শিক্ষার্থীর জন্য প্রথম পরামর্শ হলো কোনো ব্যর্থতাকে হতাশার পিন বানিয়ে আশার বেলুনটা ফুটো করা চলবে না। তোমার ক্যারিয়ার তোমার হাতে। আর চূড়ান্ত সফলতা বলে আসলে কিছু নেই। তাই যেকোনো ছোট–বড় ব্যর্থতাকে সিঁড়ি বানিয়ে ওপরে উঠতে থাকো। সহপাঠী বা সমবয়সী বন্ধুর সঙ্গে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে এবং এটা থাকাও ভালো। তবে প্রতিযোগিতা মানে এই নয় যে অন্যকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া। বরং প্রতিযোগিতা মানে নিজেকে আরও এগিয়ে নেওয়া; আর পাশে বন্ধুকে দেখতে পাওয়া।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।