পেশায় আমি আইনজীবী। বেশির ভাগ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকি। পেশাগত কারণে জনসমাগমে যেতেই হতো। তবু করোনা মহামারির শুরুর সময় থেকেই সাবধানে থেকেছি। মেনেছি স্বাস্থ্যবিধি। করোনার টিকার প্রথম দুটি ডোজও নেওয়া। তবু এ বছর ঈদুল আজহার পর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলাম।
আমি তখন ঢাকায়। দেশজুড়ে লকডাউন। বনশ্রীতে বড় ছেলের বাসায় থাকছি। এরই মধ্যে ঈদ এল। সেদিনই বড় ছেলের স্ত্রী এবং তার দুই দিন পর ছেলের জ্বর এল। তারা নিজেরা আইসোলেশনে চলে গেল। এর চার দিন পর আমারও জ্বর আসে। সবাই করোনার নমুনা পরীক্ষা করতে দিলাম। ফল এল পজিটিভ।
দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসে ভুগছি। তাই পজিটিভ রিপোর্ট পেয়ে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলাম। তবে মনোবল হারাইনি। আমার স্ত্রীর জ্বর না এলেও কাশি ছিল প্রচণ্ড। যদিও আগে থেকেই হাঁপানির সমস্যা ছিল তার।
ওদিকে আমার বড় ছেলের স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। আমি মোটামুটি ঠিক ছিলাম। কিন্তু দিন যতই পার হচ্ছিল, শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। ছেলেরা তাই আর দেরি করেনি। আমাকেও হাসপাতালে ভর্তি করায়। হাসপাতালের দিনগুলোতে মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও সন্তানদের সেবাযত্ন আর চিকিৎসকদের চেষ্টার কমতি ছিল না। নিজের মনোবল ঠিকঠাক রাখার চেষ্টা করতে থকি।
১২ দিন হাসপাতালে কেটেছে আমার। আশপাশের অনেক রোগীর অবস্থায় চোখের সামনে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। এসব দেখে যদিও নিজের মনোবল টিকিয়ে রাখা ছিল দুঃসাধ্য। তবু চেষ্টা করেছি। যেহেতু টিকা নেওয়া ছিল, চিকিৎসকেরা অভয় দিতেন। ফুসফুসের প্রায় ৩০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমার। কিন্তু আমার পায়ে রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা প্রায় ১০ বছর যাবৎ। করোনায় যেহেতু রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা হয়, চিকিৎসকেরা এ বিষয়টাতেই বেশি চিন্তিত ছিলেন। এদিকে রক্তে প্লাটিলেটও আমার কমে গিয়েছিল। এ জন্য জটিলতা তৈরি হয়েছিল। যদিও চিকিৎসক এবং ছেলেরা আমাকে তা বুঝতে দেয়নি।
চার-পাঁচ দিন জটিলতা কাটিয়ে কিছুটা সুস্থতা অনুভব করতে থাকি। আমার স্ত্রী বাসাতেই চিকিৎসা নেয়। এদিকে আমার মেজ ছেলে, তার স্ত্রী আর আমার নাতি-নাতনিরাও আক্রান্ত হয়। তবু মনোবল ঠিক রাখি। ছেলেরা অসুস্থ হলেও হাসপাতালে দিনরাত আমার পাশে পাশেই থাকত।
আমার রক্তে সুগারের পরিমাণ ওঠানামা করত। এটা ঠিক রাখাই যেন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে হাসপাতাল থেকে ছাড় পাই। এত দিনে কোভিড নেগেটিভ হলেও করোনা-পরবর্তী জটিলতা দেখা দেয়। মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, বমি এবং রক্তে সুগারের মাত্রার ভারসাম্যহীনতা ছিল প্রায় এক মাস। শারীরিক জটিলতা থাকলেও খাওয়াদাওয়া করেছি নিয়ম মেনে। চিকিৎসকদের পরামর্শে এবং পুত্রবধূর তত্ত্বাবধানে আমি এবং আমার স্ত্রী সুষম খাবার, হালকা ব্যায়াম, উন্মুক্ত স্থানে হাঁটাহাঁটি করতাম। মাঝেমধ্যে বিষণ্নতায় ভুগলেও ছেলেরা সাহস দিতে থাকত। আমরা নাতি-নাতনিদের নিয়ে মজার সময় কাটাতে চেষ্টা করতাম।
এদিকে আমার কোর্ট কার্যক্রম শুরু হলে বিচারপ্রার্থী মক্কেলদের চাপ বাড়তে থাকে। শুরুতে ফোন এড়িয়ে চলতাম। কথা বলতাম না বেশি। পরে সিদ্ধান্ত নিই, যেহেতু কিছুটা সুস্থ হয়েছি এবার কাজকর্মে মন দিলে হয়তো স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে। আর ভাবতাম করোনা যেহেতু সহসাই যাবে না, সচেতন থেকেই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হবে।
আমার বয়স ৭০-এর কাছাকাছি এবং আমার স্ত্রীও ষাটোর্ধ্ব। ঝুঁকি তো শুরু থেকেই ছিল। তবু সবার সহযোগিতা আর মনোবল ঠিক রেখে, চিকিৎসকের পরামর্শ সঠিকভাবে মেনে সুস্থ হই। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে আসি। ধীরে ধীরে কাজকর্ম করার চেষ্টা করতে থাকি। কোর্টে শুরুর দিকে নিয়মিত না যেতে পারলেও এখন প্রায় নিয়মিত যাই। যদিও সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়। মাঝেমধ্যে মাথা ঘোরার সমস্যাটা দেখা দেয়। তবু ভালো আছি অনেকটাই।