২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

৫০ বছর আগের সেই বক্তৃতায় কী বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়

স্বাধীন দেশের প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রলীগের আমন্ত্রণে ঢাকা আসেন সত্যজিৎ রায়। এর আগে সত্যজিতের বয়স যখন পাঁচ কি ছয় বছর, মায়ের সঙ্গে প্রথম ঢাকা আসেন। সেটা ছিল ব্রিটিশ ঢাকা, আর এটা স্বাধীন দেশের রাজধানী। তার এই দ্বিতীয় সফরই ছিল শেষ বাংলাদেশ সফর। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এই সফর সাকল্যে ২৪ ঘণ্টাও স্থায়ী ছিল না।

ফ্লাইট বিলম্বিত হওয়ায় সকালের বিমান আসতে আসতে দুপুর হয়ে যায়। বিকেলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সন্ধ্যায় পল্টনে ভাষণ; পরদিন সকালে এফডিসি ঘুরে সোজা এয়ারপোর্ট। ইন্টারকন্টিনেন্টালে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক প্রমুখের সঙ্গে থাকার ইচ্ছায় অপেক্ষাকৃত ছোট হোটেল পূর্বাণীতে গিয়ে ওঠেন। এই পূর্বাণীতেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেন কবি জসীমউদ্‌দীন। এরপর আসেন আমানুল হক। ’৬৫-র পর দেখা। নানা বিষয়ে জমে থাকা কথা বলতে বলতে কখন যে রাত দুটো বেজে যায়, টেরও পাননি। আলাপের মাঝে মাঝেই দূর থেকে ভেসে আসা স্টেনগানের আওয়াজ সত্যজিৎকে উত্কণ্ঠিত করে। তাঁর কাছে এ সময় যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত একটি চিত্র তুলে ধরেন আমানুল হক।

১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পুরানা পল্টনে ছাত্রলীগ আয়োজিত বিরাট জনসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা ছিলেন সত্যজিৎ রায়। ছোট্ট একটা ক্যাসেটে পুরো ভাষণটা ধরে রাখেন নাট্যব্যক্তিত্ব তবিবুল ইসলাম। সেদিনের বক্তৃতায় সত্যজিৎ কী বলেছিলেন?

সত্যজিৎ রায়
ছবি: সংগৃহীত

আমার রক্তে বইছে বাংলা ভাষা

বহুদিন থেকে শহীদ দিবসের কথা শুনে আসছি। একুশে ফেব্রুয়ারির কথা শুনে আসছি। কিন্তু এখানে এসে নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না, আমি বুঝতে পারতাম না যে আপনারা বাংলা ভাষাকে কতখানি ভালোবাসেন। বাংলা ভাষা যখন বিপন্ন, তাকে বাঁচানোর জন্য যে সংগ্রাম হয়েছিল, তাতে যাঁরা আত্মোত্সর্গ করেছেন, তাঁদের যে কতখানি শ্রদ্ধা করেন আপনারা, তাঁদের স্মৃতিকে, সেটা আমি আজকে এখানে এসে বুঝতে পারছি।

আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গে থাকি, আমরাও বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। এটা ঠিক যে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির মধ্যে আরও পাঁচ রকম সংস্কৃতির প্রভাব এসে সেটাকে একটা পাঁচমিশালি ভাব এনে দিয়েছে। ইংরেজির প্রভাব আমরা এখনো পশ্চিমবঙ্গে সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তার একটা কারণ এই বোধ হয় যে পশ্চিম বাংলা হলো ভারতবর্ষের একটা প্রাদেশিক অংশমাত্র। কিন্তু তাই বলে এই নয় যে আমরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি না। বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান, বাংলা চলচ্চিত্র, বাংলা থিয়েটার—এই সবই পশ্চিমবঙ্গে এখনো বেঁচে আছে, টিকে আছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিমচন্দ্র, শরত্চন্দ্র—এঁদের আমরা এখনো ভালোবাসি।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি যে আমি আজ ২০ বছর ধরে বাংলা ছবি করছি। এর মধ্যে বহুবার বহু জায়গা থেকে অনুরোধ এসেছে যে আমি বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করে অন্য দেশে, অন্য ভাষায় চিত্র রচনা করি। কিন্তু আমি সেই অনুরোধ বারবার প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ, আমি জানি যে আমার রক্তে যে ভাষা বইছে, সে ভাষা হলো বাংলা ভাষা। আমি জানি যে সেই ভাষাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় কিছু করতে গেলে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে, আমি কূলকিনারা পাব না, শিল্পী হিসেবে আমি মনের জোর হারাব।

আমি ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি যে পূর্ববঙ্গে নাকি আমার দেশ। আমার ঠাকুরদাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়ের নাম হয়তো আপনারা কেউ কেউ শুনেছেন। আমার তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু শিশুকাল থেকে আমি তাঁর রচিত ছেলেভোলানো পূর্ববঙ্গের কাহিনি টুনটুনির বই পড়ে এসেছি, ভালোবেসে এসেছি। তাঁর রচিত গানে আমি পূর্ববঙ্গের লোকসংগীতের আমেজ পেয়েছি। যদিও এ দেশে আমি আসিনি, আমার দেশে আমি কখনো আসিনি বা স্থায়ীভাবে আসিনি। এই সব গান, এই সব রূপকথা শুনলে আমার মনে হতো যে এই দেশের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ রয়েছে।

যখন আমার পাঁচ কি ছয় বছর বয়স, তখন আমি একবার ঢাকা শহরে এসেছিলাম। দু-তিন দিন মাত্র ছিলাম। আমার মামাবাড়ি ছিল ওয়ারীতে, র‍্যাঙ্কিন স্ট্রিটে। সে বাড়ি এখনো আছে কি না জানি না, সে রাস্তা এখনো আছে কি না জানি না। বাড়ির কথা কিছু মনে নেই, মনে আছে শুধু যে প্রাচীরে বাঁদরের উপদ্রব। সে বাঁদর এখনো আছে কি না, তা-ও আমি জানি না। তারপর মনে আছে পদ্মায় স্টিমারে আসছি, ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেছে, মা আমাকে বাইরে ডেকে এনে দেখাচ্ছেন যে পদ্মার ওপর সূর্যোদয় হচ্ছে। আর দেখাচ্ছেন যে পদ্মা আর শীতলক্ষ্যার জল যেখানে এসে মিশেছে, সেখানে এক নদীর জলের সঙ্গে আরেক নদীর জলের রঙের কত তফাত। সেই থেকে বারবার মনে হয়েছে যে একবার নিজের দেশটা গিয়ে দেখে আসতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সে আশা, বিশেষত দেশ বিভাগের পর, ক্রমেই দুরাশায় পরিণত হতে চলেছিল। হঠাৎ কিছুদিন আগে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেল, আমার কাছে আমার দেশের দরজা খুলে গেল এবং আজ শহীদ দিবসে এসে, আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে, ঢাকা শহরে এসে আমার স্বপ্ন অন্তত কিছুটা অংশে সফল হলো।

এবার আমি অনেক জরুরি কাজ ফেলে চলে এসেছি। এবার আর বেশি দিন থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আমার ইচ্ছা আছে, আমার আশা আছে যে অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এ দেশে ফিরে আসব, এ দেশটাকে ভালো করে দেখব। এ দেশের মানুষের সঙ্গে এমনভাবে জনসভায় নয়, সামনাসামনি, মুখোমুখি বসে কথা বলে তাদের সঙ্গে পরিচয় করব। এ আশা আমার আছে।

আমি আর বিশেষ কিছু বলতে চাই না, সংগীতের অনুষ্ঠান রয়েছে। আপনারা যে আমার কাজের সঙ্গে পরিচিত বা আমার কাজ সম্পর্কে যে আপনাদের কৌতূহল আছে, সে খবর আমি এর আগেই পেয়েছি। কয়েক বছর আগে যখন মহানগর ছবি এখানে দেখানো হয়েছিল, তাতে এখানকার জনসাধারণ কী ধরনের আগ্রহ, কৌতূহল প্রকাশ করেছিল এবং তার ফলে কী ঘটনার উদ্ভব হয়েছিল, সে খবর আমার কানে যখন প্রথম পৌঁছায়, আমি সে কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু তারপর এখান থেকে বহু পরিচিত-অপরিচিত ব্যক্তি, বন্ধু আমাকে চিঠি লিখে, খবরের কাগজের খবর কেটে পাঠিয়ে, ছবি কেটে পাঠিয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন সেই ঘটনার কথা। তখন বিশ্বাস হয়েছিল। আর বিশ্বাস হলে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভাবতে পারিনি যে এটা হতে পারে। একজন শিল্পী হিসেবে এর চেয়ে বড় সম্মান, এর চেয়ে গর্বের বিষয় আর কিছু হতে পারে না।

গত ২০ বছরে অনেক জায়গায় অনেক দেশে অনেকবার নানানভাবে সম্মানিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু আমি জোর গলায় আজকে এখানে দাঁড়িয়ে এই শহীদ দিবসের পুণ্য তিথিতে আমি বলতে পারি যে আজকের যে সম্মান, সে সম্মানের কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়। এর চেয়ে বড় সম্মান আমি কখনো পাইনি আর আমার মনে হয় না, আমি আর কখনো পাব।

জয় বাংলা।