হ্যাটট্রিক কন্যা স্বরলিকা এখন সংসার সামলাচ্ছে

স্বরলিকা পারভিন যখন টুর্নামেন্টের সেরা ফুটবলার, ২০১৭ (বাঁয়ে) এবং বধূবেশে স্বরলিকা, ২০২১ (ডানে)
সংগৃহীত

স্বরলিকা পারভিনের কথা অনেকেরই হয়তো মনে আছে। ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে ‘হ্যাটট্রিক কন্যা’র খ্যাতি পেয়েছিল সে। জাতীয় পর্যায়ের সেমিফাইনালে তার দল হারলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিয়েছিল স্বরলিকা। অবাক শোনালেও সেই স্বরলিকার বিয়ে হয়েছে, বাল্যবিবাহ। শুধু স্বরলিকা একা নয়, বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফুটবল দলের সাতজন কিশোরী ফুটবল মাঠের বদলে এখন সামলাচ্ছে সংসার। এদের কারোরই এখনো বিয়ের বয়স হয়নি।

কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দীঘলটারী দক্ষিণ বাঁশজানি গ্রাম। আর দশটা গ্রামের মতোই চেহারা। ব্যতিক্রম হচ্ছে এটি বিলুপ্ত এক ছিটমহল। গ্রামের তিন দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহারের দিনহাটা মহকুমার সীমানা। বছর তিনেক আগে এই গ্রামেই গঠিত হয়েছিল বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফুটবল দল। দলের খেলোয়াড় ২০ জন কিশোরী। দলটি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে অংশ নিয়ে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলার ধাপ পেরিয়ে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে জাতীয় পর্যায়ে খেলতে যায়। কোয়ার্টার ফাইনালে হ্যাটট্রিক করে দলকে জেতায় অধিনায়ক স্বরলিকা। তবে সেমিফাইনালে হেরে গিয়ে স্থান নির্ধারণী ম্যাচে চট্টগ্রামের বাঁশখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ৪-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয় হয় বাঁশজানি দল। এই ম্যাচেও হ্যাটট্রিক করে কিশোরী স্বরলিকা। শুধু বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ নয়, এরপর তার নেতৃত্বে আসে আরও নানা সাফল্য। বিলুপ্ত ছিটমহলের নতুন বাংলাদেশিদের কাছে প্রথম উপহার আসে যেন স্বরলিকা পারভিনের হাত ধরেই।

স্বরলিকার বাড়িতে

স্বরলিকার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বিষণ্ন পরিবেশ। ঘরে গিয়ে দেখা যায় টিনের ঘরে আলমারি ও টেবিলে স্বরলিকার পুরস্কারগুলো থরে থরে সাজানো। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নেওয়া পুরস্কারটি দেখিয়ে সে বলে, ‘পুরস্কারগুলো সবই আমার প্রিয়, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নেওয়া পদকের কথা কোনো দিন ভুলব না।’

বিয়ের প্রসঙ্গে উঠতেই স্বরলিকা পারভিন বলল, ‘সমাজের মানুষ নানা কথা বলে। মেয়েরা ফুটবল খেললে বিয়ে হবে না এটাও বলে। ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না। আর্থিক অনটনসহ এমন অনেক কারণে বাবা-মা আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে ছিল জাতীয় দলে খেলার।এখন আর সেই স্বপ্ন দেখি না।’

স্বরলিকার বাবা শহিদুল ইসলাম দিনমজুর মানুষ। তাঁর আয়ে পাঁচজনের সংসার চলে। করোনার সময়ে সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে স্বরলিকা পুরস্কার নিছে। ভালো লাগছিল। কিন্তু এরপর আর কেউ খোঁজ নেয় নাই। আমি চাই আমার মেয়ের মতো পরিস্থিতি যেন কারও না হয়। মেয়ে ফুটবল খেলে, এ জন্য মানুষ নানা কথা কয়। ভালো ঘর পাইছি, যৌতুক ছাড়াই মেয়ের বিয়া দিছি।’ তিনি জানালেন, স্বরলিকার স্বামী কামরুল ইসলাম পেশায় মোটরসাইকেল মেকানিক। বাড়ি একই উপজেলায়। কামরুল ইসলামও নাবালক। এখন তার বয়স ১৭ বছর। আর স্বরলিকার বয়স ১৬ বছর। নবম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা করতে পারেনি স্বরলিকা।

২০১৭ সালর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপ তৃতীয়স্থান অর্জনকারী বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল দল

অধিনায়কের পথে আরও ৬ জন

বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিল স্বরলিকা পারভিন। তার পথেই হাঁটতে হয়েছে দলটির আরও ছয় কিশোরীর। এরাও হয়তো হতে পারত বড় ফুটবলার। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে। এই ছয় কিশোরী হলো বাঁশজানি হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী জয়নব (১৫), নবম শ্রেণির শাবানা (১৬), অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রত্না (১৫), আঁখি (১৫), শারমিন (১৬) ও আতিকা (১৬)। এদের স্বামীদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।

শাবানার বাবা সাইফুর রহমান অটোরিকশাচালক। তাঁর কথায় ঝরে পড়ে ক্ষোভ। তিনি বলেন, ‘এত দূর থেকে মেয়েরা খেলতে গেছিল। শুধু যাওয়া-আসা আর থাকা-খাওয়া ছাড়া মেয়েরা কিছুই পায়নি। উল্টো খেলতে গেলে মেয়েদের পেছনে টাকা খরচ করতে হতো। করোনার আগেও রংপুরে, ঢাকায় খেলে আসছে। কোনো সহযোগিতা পায় নাই। করোনার মধ্যে স্কুল বন্ধ, আয় কমি গেছে। খরচ বাড়ছে। তাই ভালো সম্বন্ধ আসছে, মেয়ের বিয়ে দিছি।’

করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর তেমনটা নেওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান বাঁশজানি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কায়সার আলী। তিনি বলেন, ‘অনেকের বিয়ের বিষয়টি আমি পরে জানতে পেরেছি। বিয়ের সময় জানতে পারলেও বিয়ে আটকানো যেত।’

ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মা জানালেন, কিশোরী ফুটবলারের বাল্যবিবাহের বিষয়ে তিনি জানতেন না। কেউ তাঁকে জানায়নি। জানলে তিনি আইনি পদক্ষেপ নিতে পারতেন। তবে বাকি খেলোয়াড়েরা যেন বাল্যবিবাহের শিকার না হয়, সে জন্য তিনি নজর রাখার পাশাপাশি তাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

সীমান্ত লাগোয়া গ্রাম বাঁশজানি থেকে যখন ফিরে আসি সূর্য হেলে পড়েছে। পথে বাঁশজানি বিদ্যালয়টি চোখে পড়ে। বিরাট মাঠ। পাশেই পাকা শ্রেণিকক্ষ, দীর্ঘদিনের পুরোনো বটগাছটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মাঠ বছর কয়েক আগেও প্রাণবন্ত ছিল স্বরলিকাদের পদচারণে। এখন ফাঁকা মাঠটি যেন শূন্যতায় ডুবে আছে।