বাঙালি নারীর প্রথম জাপানযাত্রা
হরিপ্রভা তাকেদাকে খুঁজে পাওয়া
হরিপ্রভা তাকেদা ছিলেন ঢাকার মেয়ে। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল জাপানি নাগরিক উয়েমন তাকেদার। বিয়ের কয়েক বছর পর ১৯১২ সালে তাঁরা জাপান ভ্রমণে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে এসে হরিপ্রভা লিখেন বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা নামে একটি বই। বইটি দীর্ঘ সময় ছিল সাধারণের অজ্ঞাতে। সেই বই উদ্ধারের কাহিনি থাকছে এখানে
হরিপ্রভা তাকেদাকে আমি খুঁজে পাই অনেকটা কাকতালীয়ভাবে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকা স্টাডিজে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়তে গিয়েছি। আমার গবেষণার বিষয় জাপান। তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপকের পরামর্শে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে গবেষণার কাজ করতাম। সে সময় হঠাৎ করেই হরিপ্রভার বইয়ের দেখা মেলে।
বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা বইটির তাৎপর্য তাৎক্ষণিকভাবে অনুধাবন করতে না পারলেও ভবিষ্যতে এটা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা তখনই মনে হয়েছিল। এ কারণে যে বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে বাংলা ভাষায় জাপান নিয়ে একটি বই লেখার পর বিস্মৃত এই নারী কেন এভাবে হারিয়ে গেলেন, সেটা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছিল। এ ছাড়া জাপানের সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক, সেটাও ছিল এমন কিছু, যা কিনা ভিন্নভাবে গবেষণার দাবি রাখে। ফলে এই বই নিয়ে কাজ করার চিন্তা তখন থেকেই এবং আমার জানা দরকার ছিল এর পুনর্মুদ্রণ ঢাকা কিংবা কলকাতায় আগে হয়েছে কি না।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডন থেকে জাপানে চলে আসার পর বিভিন্ন সূত্রে খোঁজখবর নিয়ে যখন নিশ্চিত হতে পারি যে বইটি আসলেই হারিয়ে যাওয়া এক মূল্যবান গ্রন্থ। তখনই কেবল নতুন করে এটি প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি। কিছুটা সময়সাপেক্ষ সেই প্রক্রিয়ার ফল হচ্ছে প্রথম আত্মপ্রকাশের ৮৪ বছর পর ১৯৯৯ সালে সাহিত্য প্রকাশ থেকে বের হওয়া এর দ্বিতীয় সংস্করণ। বইটির পটভূমি পাঠকদের কাছে তুলে ধরার জন্য ভূমিকা ও প্রকাশকের বক্তব্য ছাড়াও ছোট আকারের আরও যে দুটি প্রবন্ধ এতে যুক্ত করা হয়, তাঁর একটি লিখেছি আমি নিজে। অন্যটির রচয়িতা জাপানের বিশিষ্ট বাংলা গবেষক কাজুহিরো ওয়াতানাবে।
হরিপ্রভাকে নিয়ে গবেষণা চালানোর পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে তথ্যের ঘাটতি। ঢাকার ব্রাহ্মসমাজের আদি যে পাঠাগার ও কার্যালয়, পাকিস্তানের বর্বর সেনারা ১৯৭১ সালে সেটা ধ্বংস করে দেওয়ায় হরিপ্রভার পরিবারসংক্রান্ত পুরোনো কাগজপত্রের কিছুই আর এখন খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে তা সত্ত্বেও ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন চেষ্টা করেছেন অন্য বিভিন্ন সূত্র থেকে সেই সময়ের অনেক কিছু তুলে আনার। এ ছাড়া হরিপ্রভার বোনের ছেলে সুরজিৎ দাশগুপ্ত পরবর্তী সময়ে মাসির মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া কাগজপত্রের সংগ্রহ থেকে খুঁজে বের করেছেন হরিপ্রভার আরও কিছু অপ্রকাশিত লেখা, যেগুলো এখন গবেষকদের জন্য মূল্যবান দলিল হয়ে আছে।
১৯৯৯ সালে হরিপ্রভার জাপান ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নতুন করে প্রকাশ হওয়ার পর থেকে ধীরে হলেও শতবর্ষের বেশি আগের এই বিদুষী নারীকে নিয়ে আগ্রহ বাংলাদেশের পাশাপাশি জাপানেও এখন বেড়ে চলেছে। কাজুহিরো ওয়াতানাবে বইটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল ২০১২ সালে হরিপ্রভাকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন।
জাপানের ইয়োকোহামা শহরে প্রতি তিন বছর অন্তর আয়োজিত চারুকলা প্রদর্শনীর ইয়োকোহামা ট্রিয়েনালের (ত্রিবার্ষিক) ২০২০ সালের আয়োজনে নতুন করে আলো ছড়ানো বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির ওপর আলোকপাত করা অংশে হরিপ্রভাকে যুক্ত রাখা হয়েছিল। ফলে হরিপ্রভা তাকেদা হারিয়ে যাননি, বরং দীর্ঘ এক বিরতির শেষে আবারও আলোচনায় ফিরে এসেছেন। সেই ধারার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে এলিজা বিনতে এলাহীর প্রামাণ্যচিত্র। এ সবকিছুই হয়তো সম্ভব হয়েছে ১৯৯৯ সালে বইটি নতুন করে প্রকাশিত হওয়ার কারণে।