শুক্র ও শনিবারে খুব সকালেই ঘুম ভাঙে পুরান ঢাকার মেয়ে তানিয়া আক্তারের। নাশতা করেই ছোটে স্কুলের দিকে। তবে বই-খাতা নয়, এই সময়ে তার হাতে থাকে হকিস্টিক। ট্রাউজার আর জার্সি গায়ে চাপিয়ে সোজা স্কুলের চৌহদ্দিতে ঢোকে। পুরান ঢাকার আনন্দময়ী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তানিয়ার মতো ২৪ জন শিক্ষার্থী এই স্কুলে নিয়মিত হকি খেলে।
তিন বছর ধরে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা হকি খেলছে। শুরুটা মোটেও সুখকর ছিল না। অনেকেই মেয়েদের হকি খেলা মানতে পারেনি। তবে হাল ছাড়েননি স্কুলের সভাপতি হাফিজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমার খুব ইচ্ছে ছিল এই স্কুলের মেয়েরা খেলাধুলা করুক। কোন খেলা দিয়ে শুরু করব ভাবতেই মাথায় এল হকির কথা। এই এলাকার মানুষের কাছে হকি খেলা বেশ জনপ্রিয়। তবে, শুরুতে কোনো মেয়ে উৎসাহ দেখায়নি পরিবার বা চারপাশের কথা ভেবে। দুজন মেয়ে নিয়েই খেলা শুরু হলো। এখন তো আমাদের মেয়েরা নানা প্রতিযোগিতায় যাচ্ছে।’
এরই মধ্যে দুটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে আনন্দময়ী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের হকি দল। ২০১২ সালে ইউসিবি ডেভেলপমেন্ট কাপ হকি এবং এ বছর অংশ নিয়েছে ওয়াল্টন দ্বিতীয় মহিলা হকি ২০১৩ প্রতিযোগিতায়। বিজয়ী হতে না পারলেও এ বছরের প্রতিযোগিতায় ভালো করেছে তারা। জিতে নিয়েছে ফেয়ার প্লে ট্রফি। এতেই নাকি উৎসাহ আরও বেড়ে গেছে এই খুদে খেলোয়াড়দের। দলের গোলরক্ষক নুরুন্নাহার আক্তার বলেন, ‘দুই বছর ধরে আমি স্কুলের হকি দলে যোগ দিয়েছি। অনেকেই আমাকে বাহবা দিয়েছে। আমি নাকি অনেক ভালো গোলরক্ষক! পড়াশোনার পাশাপাশি তাই খেলাটা চালিয়ে যেতে চাই।’
নিজেদের স্কুলের এক চিলতে মাঠেই শুক্র ও শনিবার নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলে তাদের। দুই ঘণ্টার এই প্রশিক্ষণ মাঝেমধ্যে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামেও চলে। তখন নাকি বেশি ভালো খেলতে পারে শিক্ষার্থীরা। দলের কোচ ফজলুল ইসলাম (ওস্তাদ ফজলু) মেয়েদের নিয়ে খুব আশাবাদী। এত কম সময়ে তারা যে নিজেদের এভাবে মেলে ধরবে, সেটা কোচের ধারণার বাইরে ছিল। অথচ প্রথম দিনের কথা মনে করলে এখনো তাঁর হাসি পায়। বললেন, ‘শুরু করেছিলাম দুজন মেয়ে নিয়ে। তা-ও তাদের পরিবারকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করাই। গাছের ডাল কেটে বানানো লাঠি দিয়েই চালাতে শুরু করি প্রশিক্ষণ। আস্তে আস্তে তাদের দেখে অনেক মেয়ে উৎসাহী হয়ে ওঠে। এখন তো ওদের খেলা দেখতে পুরো পরিবার ছাড়াও এলাকার লোকজন মাঠে চলে যায়।’
এরই মধ্যে হিট করা, ঠেকানো, পুশ করা, থামানো—এসব বিষয়ে বেশ ভালো কৌশল আয়ত্ত করেছে এই মেয়েরা। এরা সবাই চায় মেয়েদের নিয়ে গড়ে উঠবে জাতীয় হকি দল। আর সেখানে জায়গা করে নেবে তারা। দেশ-বিদেশে খেলবে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়িয়ে। এমন স্বপ্নে নাকি এখনি ঘুম আসে না শাহিন সুলতানার। দলের সহ-অধিনায়ক শাহিন সুলতানা বলে, ‘যখন খেলা থাকে রাতে ঘুম আসে না। সকালে যদি উঠতে না পারি এই ভয়ে। ইচ্ছে আছে দেশের হকিতে অবদান রাখার।’
তার মতো একই স্বপ্নে বিভোর দলের অন্যরাও।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাহফুজা বেগম বলেন, ‘আমাদের মেয়েরা প্রবল উৎসাহ নিয়ে হকি খেলছে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা তাদের শরীর এবং মনের জন্যও দরকারি। তা ছাড়া, মেয়ে বলে কোনো প্রতিবন্ধকতায় আটকে থাকার দিন শেষ, আমাদের মেয়েরা তারই উদাহরণ।’