একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ক্যাম্পাস থাকা যাবে না। এই ঘোষণার পর কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসল। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে মেয়েদের আলাদা ক্যাম্পাস ছিল। সেটা বন্ধ হয়ে গেল। তাদের আনা হলো আমাদের ক্যাম্পাসে। অনেক দিন পর মনে হলো, ক্যাম্পাস প্রাণ ফিরে পেল!
ক্যাম্পাসে সকাল আটটার গাড়ি যখন পৌঁছাত, তখন হইহুল্লোড় পড়ে যেত। ক্যানটিনে এক পাশে ছেলেরা, অন্য পাশে মেয়েরা নাশতা করতে বসত। অবশ্য নাশতার চেয়ে আড্ডাই ছিল মুখ্য।
একবার হলো কি, চা অর্ডার করে দাঁড়িয়ে আছি। এর মধ্যেই এক বন্ধুর ডাক, তার দিকে ফিরে তাকাতেই ঘটল সে ঘটনা। বলা নেই কওয়া নেই, আমার অর্ডার করা চা ট্রেতে করে নিয়ে যাচ্ছে একজন! কণ্ঠ ভারী করে ওয়েটারকে বললাম, ‘কী ব্যাপার?’
সে বলল, ‘চা তো আপনাকেই দিছি। আফা নিয়া গেল।’
না, এটা মানা যায় না। এ কেমন অভদ্রতা! মেজাজ খারাপ করে মেয়েটার কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, ‘চা দিল আমাকে, আপনি নিয়ে এলেন কেন?’ একসঙ্গে তারা চারজন বসা ছিল, চার জোড়া চোখ তখন আমার দিকে।
মেয়েটা বলল, ‘কয়েক দিন ধরে খেয়াল করছি, আপনি ওপাশ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আজকে সুযোগ পেলাম আপনাকে শিক্ষা দেওয়ার। যান, এবার ওপাশে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন আর চা খাওয়া দেখেন!’
কী সাংঘাতিক কথা! চিনি না, জানি না, একটা মেয়ে এভাবে অপমান করল! আমি তাকিয়ে থাকি তাদের দিকে। গড়গড় করতে করতে চলে আসি বন্ধুদের তল্লাটে।
প্রশাসনিক ভবনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সামনে এসে দাঁড়াল অদ্রি। আমি তো রীতিমতো হকচকিত। কারণ, তখনো ক্যাম্পাসে ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে কথা বলবে, সে চল চালু হয়নি। এই অপ্রস্তুত অবস্থায় পেছন থেকে সিরাজ স্যার এসে আসামি পাকড়াও করার মতো বললেন, ‘এই, তোমাদের আইডি কার্ড দাও। আর প্রশাসনিক ভবনে চলো।’
এরপরও ওরা ক্যানটিনে এসেছে, খেয়াল করেছি বটে, কিন্তু রাগে-ক্ষোভে তাকাইনি। চতুর্থ দিনও বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। মেয়েটা ট্রে হাতে চার কাপ চা নিয়ে এল আমাদের সামনে। চায়ের কাপ রেখে বলল, ‘আজকে আমি ওয়েটার হিসেবে চা এগিয়ে দিতে এলাম। আর এটাও বলতে এলাম যে চা পানের সময় আমি যেন আপনাকে দেখি, সেই হিসাব করে বসবেন। না হলে পরেরবার গায়ে চা ঢেলে দেব।’
কী সাংঘাতিক মেয়ে! বন্ধুদের মধ্যে শোরগোল বেধে গেল। আজহার তো বলেই বসল, ‘দেখছ বন্ধু, তোমারে বলছিলাম, কয়টা দিন ইগনোর করো। মেয়েরা এই বিষয়টা একদম সহ্য করতে পারে না। হলো তো এবার।’
ষষ্ঠ দিনে আবার দেখা। এবার দুজনে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার মধ্যে আড়ষ্টতা দেখে সে বলল, ‘ওভাবে তাকিয়েই থাকবেন? কথাবার্তা বলবেন না?’ কথাটুকু শেষ করেই একটা কাগজ হাতে দিয়ে সে চলে গেল। তাকিয়ে দেখি, মুঠোফোন নম্বর, পাশে লেখা—অদ্রি। কাগজ থেকে পারফিউমের গন্ধ ভেসে এল। আমি যেন হারিয়ে গেলাম অদ্রি ভুবনে।
ফোন নম্বর হাতে পেলেও কেন জানি কল দিতে ইচ্ছা করল না। ভাবলাম, আরেকটু আমাকে নিয়ে ভাবুক, এ চিন্তা কাজ করতে লাগল মনে!
সপ্তম দিন অ্যাসাইনমেন্টের চাপ ছিল। ক্যানটিনে যাওয়া হয়নি। ত্রস্ত পায়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সামনে এসে দাঁড়াল অদ্রি। আমি তো রীতিমতো হকচকিত। কারণ, তখনো ক্যাম্পাসে ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে কথা বলবে, সে চল চালু হয়নি। এই অপ্রস্তুত অবস্থায় পেছন থেকে সিরাজ স্যার এসে আসামি পাকড়াও করার মতো বললেন, ‘এই, তোমাদের আইডি কার্ড দাও। আর প্রশাসনিক ভবনে চলো।’
প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে রীতিমতো জেরা শুরু করল। আমার তো যায় যায় অবস্থা। অদ্রি দেখি বলিষ্ঠ, সে বলল, ‘স্যার, উনি আমার হবু স্বামী। আগামী মাসে আমাদের বিয়ে। ক্যাম্পাসে ছেলে–মেয়ে কথা বলা নিষিদ্ধ জানি। কিন্তু হবু স্বামীর সঙ্গে কথা বলাতে যদি নিষেধ থাকে, তাহলে আমার বাসায় ফোন দেন।’ অদ্রি এত দৃঢ়তার সঙ্গে বলল যে উপস্থিত সবাই স্বাভাবিকভাবে নিল।
প্রশাসনিক ভবন থেকে আমাকে প্রধান ফটকের দিকে হাঁটতে বলল অদ্রি। আমি বাধ্য ছাত্রের মতো তার সঙ্গে চললাম। আমি তার সাহসিকতায় তখন এটাই মুগ্ধ যে সে আমার হাত ধরে হাঁটছে, সে বোধও টের পেলাম না।
সেই প্রথম কোনো যুগল হাত ধরে ক্যাম্পাসে হাঁটছে। এক বিরল দৃশ্য অবাক দৃষ্টিতে দেখল সবাই।