‘তোর সঙ্গে কথা আছে। জরুরি। একটু সময় দে, দেখা করি।’
ফেসবুকের ইনবক্সে হঠাৎ টোকা। নক করেছে আমারই এক বন্ধু। তার আসল নাম–পরিচয় উহ্য রাখাই ভালো। শুধু বলে রাখি, আমার এই ছেলেবন্ধুটি বিবাহিত, নামকরা বেসকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ধরা যাক, তার নাম মাইন। তো, ফেসবুকের ইনবক্সে মাইনের এই অস্থির টোকা অস্থিরতা জাগাল আমার মধ্যেও। ভাবছি, ‘কী হয়েছে ওর? বউ–বাচ্চা নিয়ে সুখেই তো ছিল, কী হলো হঠাৎ?’
মাইনের যা হয়েছে, সেটাকে পুরোনো আমলের মানুষদের কেউ কেউ শুনলে বলতে পারেন, ‘কী ভয়াবহ! এটা হতেই পারে না।’
মাইনের সঙ্গে অতঃপর দেখা হলো আমার। সেই কথায় কথায় যেসব চরিত্র এল, তারা বাস্তব হলেও সংগত কারণে এ লেখায় ব্যবহার করা হয়েছে ছদ্মনাম। সেদিন মাইনের কথা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ, ‘ছন্দা আমাকে বুঝতে পারে না, ওকে আমি ডিভোর্স দিচ্ছি, দোস্ত।’
‘মানে! তোর আর ছন্দার তো প্রেমের বিয়ে। বেশ সুখেই ছিলি। কী বলিস এসব!’ রেগেমেগে বললাম কথাগুলো।
‘আমার কলিগ শারমিনের সঙ্গে আমার প্রেম হয়েছে। আমাকে বোঝে সে। ওকে ছাড়া আমার চলবে না। ছন্দাকেও বলেছি, আমি প্রেমে পড়েছি। শারমিন ছাড়া আমি সুখী হব না।’
মাইনের কথা শুনতে শুনতে মনে এল সায়ানের গান, ‘ওখানেই সুখ ছিল একদিন, দেয়ালের ঝুলন্ত মাকড়সার জালে জড়িয়ে সুখ ছিল একদিন, একটাই ভাঙা অ্যাশট্রে, ওটাতেও সুখ ছিল একদিন।’
এই সুখ, এই প্রেম ‘নেই’ হয়ে যায় কেন?
সুখ আর প্রেমের মধ্যে সম্পর্ক বড় গাঢ়। পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে কুবের স্ত্রী মালাকে ফেলে কপিলাকে নিয়ে দূরে যেতে চায় । স্ত্রী–সংসার আছে, তারপরও প্রেমের টানে স্ত্রী–সংসার ফেলে নতুন সংসার গড়ে মানুষ, কোন টানে?
এ মুহূর্তে মনে পড়ছে কিংবদন্তি গায়ক জন লেননের কথা। প্রথম স্ত্রী সিন্থিয়াকে ফেলে লেনন বিয়ে করলেন ইয়োকো ওনোকে। সিন্থিয়া ছিলেন লেননের সহপাঠী, একসঙ্গে পড়াশোনা করতে গিয়ে কখন যে একে অপরের মন দেওয়া–নেওয়া, তারপর বিয়ে, সংসার। পরে সেই সংসার ভেঙেই তো ওনোর সঙ্গে গাঁটছড়া। দ্বিতীয় প্রেমের সময় বিটলসের এই গায়ক বলেছিলেন, ওনোকে ছাড়া তাঁর পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
এমন করে কেন বলেছিলেন লেনন? তবে কি সিন্থিয়া–লেননের বোঝাপড়ায় কোনো সমস্যা ছিল, না ওনোর প্রবল প্রেম তাঁকে উন্মাতাল করেছিল?
প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে যাননি লেনন।
উত্তর দেননি বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিপ্লবীদের একজন চে গুয়েভারাও, কেন প্রথম স্ত্রী হিল্ডাকে ছেড়ে আলেইদা মার্চকে বিয়ে করলেন তিনি।
আমাদের দেশে, সমাজে–চারপাশে বিখ্যাত ব্যক্তি, তারকা থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যক্তিদের অনেকের মধ্যে এটি দেখা যায়।
ইদানীং বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনা হাতে গোনা নয়। চারপাশে তাকালে আমাদের চেনা অনেককেই পাওয়া যাবে, যাঁরা স্ত্রীকে এসে বলছেন, ‘নতুন করে আমি প্রেমে পড়েছি, আমি তার সঙ্গেই থাকতে চাই।’
হ্যাঁ, এ দেশের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিও স্ত্রী–সংসার ফেলে নতুন ভালোবাসার টানে নতুন করে ঘর বেঁধেছেন। তবে এখন এ রকম ঘটনা ঘটছে আগের চেয়ে বেশি মাত্রায়। তথ্য–উপাত্ত বলছে, শহরগুলোতে বেড়েছে বিবাহবিচ্ছেদের মাত্রা।
তবে ‘দুজনার পাশাপাশি বনছে না’ গানের এ কথার মতো, আমাদের সমাজে নতুন কোনো সামাজিক রূপান্তর কি ঘটেছে এরই মধ্যে?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে একে অপর থেকে দূরে সরে গেছি আমরা। সারা দিন মেতে থাকি কাজে আর নানা ব্যস্ততায় । সঙ্গীকে, পরিবারকে যতটা সময় দেওয়া প্রয়োজন, অনেক ক্ষেত্রেই তা দেওয়া হয়ে ওঠে না। আর প্রযুক্তির সংস্পর্শে আমাদের আবেগ–অনুভূতিরও বদল ঘটেছে। ফলে নিজেদের মধ্যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বোঝাপড়ার মাত্রা গেছে কমে’।
আবার প্রেমের সময় যে জীবন গোলাপ ফুলমাখা, বৈবাহিক অবস্থায় সেখানে থাকে রোজকার তেল–নুনের দায়। এ নিরেট বাস্তবতা। কিন্তু গতিশীল নাগরিক জীবনে এখন আমাদের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, কাজের সূত্রে প্রতিনিয়ত সঙ্গী থেকে আমাদের দীর্ঘ সময় দূরে থাকতে হয়। মনোবিদদের ভাষায়, ‘এর ফলে নিজেদের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আবেগ–অনুভূতি কমে যাচ্ছে। সম্পর্কের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে দূরত্ব বা গ্যাপ।’
মনোবিদেরা যাকে ‘গ্যাপ’ বলছেন, মাইনের মতো কারও কারও জীবনে সেই ‘গ্যাপ’ গলেই হয়তো ঢুকে পড়েছে নতুন সঙ্গী।
‘তারা সুখের লাগি চাহে প্রেম’। কিন্তু এই প্রেমপ্রবণতা, স্ত্রীকে ছেড়ে যাওয়া কি সমাধান? এটি কি ভালো না মন্দ?
কেউ বলবেন ভালো, অনেকেই বলবেন, মন্দ। কিন্তু মনোবিদদের একটি জোরালো প্রেশক্রিপসন আছে এখানে; স্ত্রীর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক, আবেগ বোঝাপড়াগুলো ঝালিয়ে নিন। সন্তান থাকলে সবার আগে চিন্তা করুন তার ভবিষ্যৎ। তবে অন্তিম দফায় মনোবিজ্ঞান এ–ও বলে যে সুখের জন্যই তো সবকিছু করতে চায় মানুষ।
প্রত্যেক মানুষই তাঁর অবস্থানে থেকে নিজের সুখের খোঁজই করেন জীবনভর।
আমার বন্ধু মাইনও কি তাহলে সুখের সন্ধানে যেতে চায় শারমিনের কাছে? মনকে প্রশ্ন করি। মন নিরুত্তর। বরং মনের মধ্যে গুনগুন করে রবিঠাকুরের গানের খণ্ডাংশ, ‘তারা সুখের লাগি চাহে প্রেম’।