সেরা পুরুষ মডেল পলাশ
পুলিশের ছেলে পুলিশ হবে। ছোটবেলা থেকে বাবা তা–ই বলে এসেছেন। কিন্তু বড় হতে হতে ছেলের মনে উঁকি দেয় অন্য স্বপ্ন। ফ্যাশন শোর মঞ্চে রঙিন আলোর ঝলকানির ভেতর একটা আত্মবিশ্বাসী মুখ। হেঁটে সামনে এসে দাঁড়াতেই চারদিক থেকে মুহুর্মুহু করতালি আর ক্যামেরার ক্লিক, ফ্ল্যাশগানের আলোর ঝলকানি। শেষমেশ ছেলের স্বপ্ন সত্যি হলো। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়ে ছেলেটি জিতে নিল ‘এশিয়ার সেরা পুরুষ মডেল’ খেতাব!
বলছিলাম বাংলাদেশের ছেলে মেহেদি হাসানের কথা, যিনি মডেল পলাশ হিসেবে পরিচিত। কুমিল্লার ছেলে পলাশ, বাবা মো. ফারুক হোসেন সরকারি চাকরিজীবী। সেই সুবাদে পলাশ পরিবারের সঙ্গে ঘুরেছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। মিশেছেন নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে। আর এসব বিষয়ই তাঁকে শুরু থেকে আলাদা করেছে অন্য প্রতিযোগীদের থেকে। দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়ার আগে পলাশ জিতেছিলেন ফেস অব বাংলাদেশ ২০১৯ প্রতিযোগিতায় রানারআপের পুরস্কার। তবে কোরিয়ায় গিয়ে যে সরাসরি এত বড় পুরস্কার পাবেন, সেটা নিজেও বুঝতে পারেননি।
পলাশ বলেন, ‘ওখানে এশিয়ার ২৭টি দেশ থেকে নির্বাচিত ৪ জন করে মডেল অংশ নেন। সব মিলে ১১০ জন প্রতিযোগী। বাংলাদেশ থেকে আমরা ৫ জন নির্বাচিত হয়েছিলাম। তবে ভিসা–সংক্রান্ত জটিলতায় মানসী কান্তা সরকার যেতে পারেননি।’
বাংলাদেশ থেকে মডেল বাছাই করতে স্যান্ডালিনা ফেস অব বাংলাদেশ ২০১৯ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ক্রসওয়াক কমিউনিকেশন এবং কোরীয়–বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান কোরবান। তাদের সঙ্গে অংশীদার হিসেবে ছিল পারসোনা, প্রথম আলো ডটকম, ক্যানভাস, এবিসি রেডিও, হোটেল লা মেরিডিয়ান ও নাগরিক টেলিভিশন।
স্যান্ডালিনা ফেস অব বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় প্রাথমিক পর্বে আবেদন করেছিলেন ৫ হাজার প্রতিযোগী। সেখান ৩০ জন ছেলে ও ৩০ জন মেয়েকে ঢাকার সীমান্ত স্কয়ারে গত ২১ ও ২২ মার্চ ডাকা হয় অডিশনে। চারটি বিষয়ে তাঁদের যাচাই করা হয়। নির্বাচিতদের নিয়ে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাসের গ্রুমিং চলে। আজরা মাহমুদ গ্রুমিং অ্যান্ড কাস্টিং স্টুডিওর সহযোগিতায় যেখানে দেশসেরা ব্যক্তিরা মডেলদের নানা বিষয় শেখান। এরপর চূড়ান্ত পর্বের জন্য নির্বাচিত হন ১০ জন ছেলে ও ১০ জন মেয়ে। গত ২৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় রাজধানীর লা মেরিডিয়ান হোটেলে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত এশিয়ান মডেল ফেস্টিভ্যালের জন্য নির্বাচিত হন পাঁচজন। চ্যাম্পিয়ন হন মারুফ রহমান ও শিরিন শিলা, রানারআপ হন মেহেদি হাসান পলাশ ও সাহেলা মজুমদার নিধি। আর বিশেষ বিবেচনায় পঞ্চম বিজয়ী হিসেবে মানসী কান্তা সরকারের নাম ঘোষণা করা হয়।
মানসী বাদে বাকি চার প্রতিযোগী গত ২২ মে বাংলাদেশ থেকে রওনা দেন দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্দেশে। নেমেই অন্য দেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে গ্রুমিংয়ে অংশ নেন তাঁরা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ২৭টি দেশের ১১০ জন মডেলকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে গ্রুমিং চলতে থাকে। নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে প্রতি মডেলকে ১০ থেকে ১৫টি পর্ব পার করতে হয়েছে। এই সময়ের মধ্যেই ডিজাইনার শো ও স্কলার শো নামে দুটি আলাদা আয়োজন হয় ১১০ মডেলকে নিয়ে।
গত ৭ জুন সিউলের অলিম্পিক হলে শুরু হয় ফেস অব এশিয়ার গালা রাউন্ড। যেখানে শুরুতে ১০ জন ছেলে ও ১০ জন মেয়ে মডেল বাছাই করা হয়। যাঁরা পান স্পন্সর প্রাইজবন্ড। বাংলাদেশের চার প্রতিযোগীর মধ্যে পলাশ উঠে আসেন এই পর্বে। পান ওশিয়া ব্র্যান্ডের প্রাইজবন্ড। এরপর সেরা দশের নাম ঘোষণা করা হয় (৫ জন ছেলে, ৫ জন মেয়ে। সেখানে নিজের নাম দেখে দারুণ খুশি হন পলাশ। তখনো নিজেকে সেরা ভাবতে পারেননি পলাশ। বলেন, ‘আমি তো কখনোই ভাবি নাই সেরা হব। তাই নিজের নাম সেরা দশে দেখেই আনন্দে বুকটা ভরে ওঠে।’ এই আনন্দ কয়েক মিনিটের মধ্যে আরও দ্বিগুণ হয়ে আছড়ে পড়ে পলাশের বুকে। যখন মঞ্চে ঘোষিত হয় ‘এশিয়ার সেরা পুরুষ মডেল বাংলাদেশের মেহেদি হাসান পলাশ।’ এ ছাড়া আরও দুটি বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়। সেরা নারী মডেল ও গ্র্যান্ড প্রাইজ নামে এই দুটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জেতেন চীন ও ইন্দোনেশিয়ার দুজন নারী মডেল।
বিশ্ব আসরে দেশের নামের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করা যে কী গৌরবের, সেটা মেহেদি হাসান পলাশের সঙ্গে প্রায় এক মাস পরে কথা বলেও ঠিক বোঝা যায়। প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে পলাশ যখন শোনাচ্ছিলেন নাম ঘোষণার মুহূর্তের কথা, তাঁর চোখ তখন টলমলে। বলতে থাকেন, ‘আব্বুকে যেদিন বলেছিলাম আমি মডেলিং করতে চাই, আব্বু রাজি ছিলেন না। তিনি চাইতেন, আমি সাব–ইন্সপেক্টর (এসআই) হই। অনেক বোঝানোর পর একদিন বলেন, ‘যাও, দেখো, কিন্তু আমি এই পেশায় কোনো সাহায্য করতে পারব না। আরেকটা শর্ত, তোমাকে অনার্সের পর এসআই পদে পরীক্ষা দিতে হবে।’ বাবার এই অনুমতি পেয়ে নিজেকে প্রমাণের চেষ্টায় লেগে পড়লাম। ২০১৭ সালে জাতীয় জাদুঘরে একটা ফ্যাশন শোতে হাঁটার সুযোগ দেন মডেল আসিফ খান। এই শুরু।
সেদিন ৫০০ টাকা সম্মানী পেয়ে সে খবর সবাইকে জানাতেই পলাশ ফোনে বিল তুলে ফেলেছিলেন তার চেয়ে বেশি। এরপর মেকআপশিল্পী বাপন রহমানের পরামর্শে নিজের একটা পোর্টফোলিও তৈরি করেন। ফটোশুটের ছবি ফেসবুকে দিয়ে ছোটখাটো কাজের সুযোগও আসতে থাকে। জিমে গিয়ে শরীর গঠনের দিকে ঝুঁকতে থাকেন পলাশ। এবার বাপন রহমান পরামর্শ দেন একটা গ্রুমিং করার। পরিচয় করিয়ে দেন মডেল ও কোরিওগ্রাফার আজরা মাহমুদের সঙ্গে। আজরা মাহমুদ শুরু থেকেই পলাশকে পরামর্শ দিয়েছেন নিজেকে ভাঙার। এই ভাঙা মানে পলাশের শরীরকে ভেঙে নতুন করে গড়ার। কারণ, না বুঝে অনেকটা বডি বিল্ডারদের মতো শরীর বানিয়েছিলেন তিনি। গুরুর পরামর্শে নতুন নিয়মে নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করেন পলাশ। এরই মধ্যে একে একে দেশের নামকরা ডিজাইনারদের পোশাকে বড় বড় ফ্যাশন শোতে হেঁটেছেন পলাশ। আর ২০১৯ সালে এসে তো পেলেন আরও বড় পুরস্কার। গোটা এশিয়ার সেরা পুরুষ মডেল হওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়।
>একনজরে পলাশ
নাম: মেহেদি হাসান পলাশ
ডাকনাম: পলাশ
বাবা: মো. ফারুক হোসেন
মা: পারভীন আক্তার
২ বোন: ফারজানা আক্তার ও ফারহানা আক্তার
প্রিয় খাবার: মুরগির মাংস
প্রিয় পোশাক: টি–শার্ট ও নীল জিনস প্যান্ট
উচ্চতা: ৬ ফুট ১ ইঞ্চি
প্রিয় রং: নীল ও কালো
প্রিয় ব্র্যান্ড: আড়ং
প্রিয় মডেল: নিবিড় আদনান নাহিদ (বাংলাদেশ)
মার্লোন টেইজেইরা (ব্রাজিল) ২