সুন্দরবনে তিন দিন
নোঙর তুলে এমভি কোকিলমনি যখন সুন্দরবনের দিকে রওনা দিল, তখন রূপসা নদীর পাড়ে আলোর ঝলকানি আর ঢাকের শব্দ। দুর্গাপূজার নবমী ছিল সেদিন। শহরের উৎসব দূর থেকে দেখতে দেখতেই চলে যাচ্ছিলাম সুন্দরবনের দিকে। পরবর্তী তিনটা দিন ফেসবুকের লাইক, কমেন্টের বুদ্বুদের জগৎ থেকে দূরে।
ধীরে ধীরে দিনের আলো মিলিয়ে গেল। চাঁদের আলো বাড়ছে চারপাশে। অক্টোবরের রাতটা ঠান্ডা হতে বেশ সময় নিচ্ছিল। তবে আমাদের গল্প জমতে সময় নিল না। লঞ্চের সামনের ডেকটায় পেছনের ইঞ্জিনের শব্দ তেমন আসে না বললেই চলে। তাই সেখানেই জমে উঠল আড্ডা। সারা দিনে ট্রেনের শব্দে যে কথাগুলো হারিয়ে গিয়েছিল, রূপসা নদীতে সেই রাতেই নির্জনতায় ফিরে এল তারা বারবার। লঞ্চ মোংলা থেমে আরও খানিকটা এগিয়ে গেল ঢাংমারি ফরেস্ট অফিসের দিকে। রাতের খাওয়ার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে সবাই চলে গেল নিজ নিজ কেবিনে। সে রাতে ঢাংমারি ফরেস্ট অফিসের কাছেই নোঙর করল আমাদের এমভি কোকিলমনি।
বাঘের খোঁজে
ভোরে ঘুম থেকে কাউকে ডেকে তুলতে হলো না। নোঙর তোলার ঘটর ঘটর শব্দে সবার ঘুম ভেঙে গেল প্রায় একসঙ্গেই। তখনো ভালো করে দিনের আলো ফোটেনি। কিন্তু আমাদের ভীষণ তাড়া। আজ বিকেলের মধ্যে কটকা যাওয়ার পরিকল্পনা। এর মধ্যে হারবাড়িয়াতে একটু ঢুঁ মারার চিন্তাও আছে। আপাতত সেই চিন্তা না করে প্রবল জোয়ারে ভেসে আসা লতাগুল্ম পাশ কাটিয়ে লঞ্চের এগিয়ে যাওয়া দেখি। কী দারুণ কর্মহীন সকাল। রাস্তায় গাড়ির কান ফাটানো হর্নের বদলে বন্ধুর প্রিয় কণ্ঠস্বর। আহা জীবন!
হারবাড়িয়া ইকোপার্কের কাঠের ঘাটে ওঠাটাও বেশ অ্যাডভেঞ্চারের ব্যাপার। লঞ্চ থেকে সারি ধরে পেছনে বেঁধে রাখা নৌকাগুলোতে উঠে হারবাড়িয়া খালের ভেতর দিয়ে এখানে এসেছি বাঘ দেখতে। শুনেছি এখানের বিস্তীর্ণ গলা সমান ঘাসের ভেতর দিয়ে বাঘ ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গে থাকা বনপ্রহরী সেটাই বলল অনেক আগ্রহ নিয়ে। আমরাও কেমন একটা গা ছমছমে ভাব নিয়ে বাঘ খুঁজি। বাঘের দেখা পাই বা না পাই, খোঁজার মধ্যেও কেমন যেন একটা রোমাঞ্চ বোধ করছিলাম। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, লঞ্চে নিরাপদ দূরত্বে বসে বাঘ দেখাটাই অনেক ভালো। কী দরকার হঠাৎ করে সামনে আসা বাঘ দেখার। সেটা যে খুব একটা সুখকর হবে না, তা তো নিশ্চিত।
সে যা–ই হোক, বনপ্রহরী রবিউল ভাইয়ের জন্য খানিকটা মন খারাপ হলো। বেচারা খুব করে চাইছিলেন আমাদের একটা বাঘ দেখাতে। সুন্দরবনের বনপ্রহরী ভাইয়েরা আসলেই এমন আন্তরিক। আত্মীয়স্বজন ফেলে মাসের পর মাস এমন জঙ্গলে পড়ে থাকেন বলেই হয়তো দুই দিনের জন্য আসা পর্যটকদের সহজেই আপন করে নেন।
কটকায় থামল কোকিলমনি
সেখান থেকে আবার আমাদের পথচলা শুরু। আমরা শহুরে মানুষ খালের দুই পাড়ের কাদা–পানি দেখে জোয়ার-ভাটা বোঝার চেষ্টা করি। আমাদের লঞ্চ এখন হারবাড়িয়া খাল ধরে শ্যালা নদীর দিকে চলতে শুরু করল। আমাদের এখন আর কিছু করার নেই। কেউ কেউ ছাদে বসে প্রকৃতি দেখছে, কেউ গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে আর কেউ কেউ ডেকে বসে লুডু খেলছে। এ এক অখণ্ড অবসর। এর মধ্যেই গাইড সোহাগ তার দলবল দিয়ে এটা-সেটা খাওয়া-দাওয়া পাঠিয়েই যাচ্ছে। ইঞ্জিনে একটানা গো গো শব্দ করে আমাদের ভাসমান বাড়িটা পানি কেটে এগিয়ে চলেছে। একে একে তাম্বুলবুনিয়া, হরিণ টানা ফরেস্ট অফিস, দুধমুখী, সুতপি হয়ে বিকেলের আগেই নোঙর করল কটকা ফরেস্ট অফিসের সামনের খালে। আমাদের আগেও আরও কয়েকটা লঞ্চ এসে হাজির এখানে।
বেলা পড়ার আগে আগে আমরা নেমে পড়লাম লঞ্চের পেছনে বেঁধে রাখা নৌকা দুটিতে। উদ্দেশ্য, কটকার আশপাশের খালের ভেতর ঘুরে বেড়ানো। নৌকার ইঞ্জিনের ট্যাট ট্যাট শব্দ বনের নীরবতা ভেঙে দেয়। এই শব্দে আশপাশের পশুপাখিরা অন্যত্র চলে যায়। কেবল দূর থেকে কয়েকটা হরিণ, বানর আর ভোঁদড় চোখে পড়ে। নৌকার মাঝিকে অনুরোধ করে ইঞ্জিন বন্ধ করিয়ে দিলাম বনের নীরবতা উপভোগ করার জন্য। ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেল। এখন গাছের পাতাগুলোর গায়ে গায়ে ঘষাঘষির শব্দটাও কী পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। কোথাও একটানা ডেকে যাচ্ছে নাম না জানা কোনো পাখি। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বড় সাদা বকটার বাতাস কাটার শব্দও যেন আমার কানে আসে। বনের মধ্যে সন্ধ্যা হয় খুব দ্রুত। এক সুদীর্ঘ রাতের প্রস্তুতি বনজুড়ে। আমরাও নৌকার নাক ঘুরাই লঞ্চের দিকে। অন্ধকার হয়ে আসার আগেই পৌঁছাতে চাই সেখানে। কাল ভোরের আলো দেখব সুন্দরবনের গভীরে, বেরিয়ে পড়ব সুন্দরবনের জেগে ওঠা দেখতে।
আলো ফুটল সুন্দরবনে
চারপাশে আলো তেমন ফোটেনি, নৌকা দুটি সরু খালের ভেতর। লগি–বইঠা দিয়ে ধীরে ধীরে চলছে সেগুলো। আমরা চুপ করে বসে সুন্দরবনের জেগে ওঠা দেখি। হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় এমন দূরত্বে একপাল হরিণ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। খালপাড়ের নরম কাদামাটিতে মাডস্কিপার মাছের হামাগুড়ি দিয়ে চলা দেখে বেশ আনন্দ পেয়েছি। কোথাও যেন একটা কাঠঠোকরা পাখি গাছে ঠোকর দিয়েই যাচ্ছে। খালের এক পাড়ের অনুচ্চ গাছের ডালে বসে মাছরাঙা পাখিটা গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে খালের পানির দিকে। এ এক অন্য সুন্দরবন। অপূর্ব তার রূপ।
সকালে নাশতার পর দলের কয়েকজন নৌকা নিয়ে নেমে পড়লাম কটকা সৈকতে। উদ্দেশ্য এখান থেকে হেঁটে হেঁটে কচিখালি পৌঁছানো। সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে আমাদের পথযাত্রা। সৈকতজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা মরা গাছের ডালপালা সৈকতটাকে দিয়েছে ভিন্ন এক রূপ। সৈকত ছেড়ে বনের ভেতর ঢুকতে পথিমধ্যে চোখে পড়ল বাঘের বেশ কয়েকটা পায়ের ছাপ। বনপ্রহরী আমাদের সামনে সামনে হাঁটছেন। আর খানিক পরপর সতর্ক করে দিচ্ছেন। কোন ছাপ কত পুরোনো, কোন ছাপ একদমই নতুন, সেটা আমাদের জানাচ্ছেন একটু পরপর। কেমন একটা গন্ধ চারপাশে। মনে হচ্ছিল বাঘ আশপাশেই কোথাও আছে। হাতে ধরে থাকা মরা ডালটাই একমাত্র ভরসা। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি আর ফিসফাস কথা বলা। এভাবেই ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর কচিখালিতে গিয়ে আবার লঞ্চে।
সুন্দরবনে শেষ রাত
কাল ভোরেই যাত্রা শুরু করব খুলনার দিকে। এই রাতটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বিকেলে দুই নৌকা নিয়ে চলে গেলাম কচিখালি সাগর মোহনায়। সঙ্গে প্যাকেটভর্তি বৈকালিক চা-নাশতা। মোহনায় পৌঁছে নৌকা দুটিকে জোড়া দিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলাম। সাগর থেকে আসা বড় বড় ঢেউয়ের ওপর দুলছে আমাদের নৌকা দুটি। কী যে এক অনুভূতি, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ঢেউয়ের মাথায় দুলতে দুলতেই চলল আমাদের চা-চক্র। তারপর শুরু হলো গানের আসর। লালনের গান, দেশের গান আর আধ্যাত্মিক গানে বিমোহিত নৌকার সবাই। একজনের গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে বাকিরা।
চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। আকাশে বড় চাঁদখানা যে কখন উঠেছে, টেরও পাইনি। একটা–দুটো করে ফুটতে ফুটতে তারাগুলো পুরো আকাশের দখল নিয়েছে। সাগর থেকে আসা বাতাসটাও বেশ আরাম দিচ্ছে। বন্ধুর দরদি কণ্ঠের সুর ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। এ এক অপার্থিব পরিবেশ। আমাদের আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। আমাদের আর কিছু করার ইচ্ছা নেই। আজ রাতে আমরা আর কোথাও যাব না। আমরা এখানেই থেকে যাব।
ফখরুল আবেদীন: লেখক ও ব্যাংকার