সুন্দর মাস্কে সুরক্ষা
করোনাকালে মাস্ক নিত্যদিনের জরুরি সঙ্গী। সাধারণ মানুষের জন্য কাপড়ের মাস্কই ভালো, এমন কথা বিশেষজ্ঞদের। সেই কাপড়ের মাস্কে জমে উঠেছে নকশার বৈচিত্র্য। এমন মাস্ক যেন হয়ে উঠেছে ফ্যাশনের অনুষঙ্গও।
‘তোমার মুখশ্রী সঙ্গী আমার এবং
দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণের ঘোর কেটে গেলে
তোমার রূপের টানে ফিরে আসি তোমার কাছেই।’
কবি শামসুর রাহমানের বর্ণনায় উঠে আসা এই মুখশ্রীকে ঢেকে রাখাই আজকের পৃথিবীর নিয়ম। করোনাকালে মুখোশ মানে মাস্ক পরেই চলছে চলাফেরা। দৈনন্দিন কাজে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় মাস্ক পরা আবশ্যক। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার নানা বিধি-নিয়মের মধ্যে মাস্কের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই এই মুখোশই এখন মুখের সঙ্গী। সেই মাস্কও হতে পারে ফ্যাশনের অনুষঙ্গ, স্টাইলিশ।
এন–৯৫, কেএন–৯৫ কিংবা সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহারের হ্যাপা কম নয়। উচ্চমূল্য একটি বিষয়, করোনাকালের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের জন্য এগুলো খুব একটা উপযোগী নয়। তুলনামূলক কম মূল্যে কিছু মাস্ক কিনতে পাওয়া গেলেও সেগুলোর গুণগত মান নিয়ে থেকে যায় সংশয়। এসব মাস্ক ফেলে দেওয়ার নিয়মও অন্য রকম। সার্জিক্যাল মাস্ক একবার মুখ থেকে সরিয়ে ফেললে আবার তা পরা উচিত নয়। তাই সব দিক থেকে কাপড়ের মাস্কই শ্রেয়। পরিষ্কার করে নিয়ে আবার ব্যবহারের সুযোগ থাকছে। দৈনন্দিনের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার পাশাপাশি ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে সুন্দর নকশার কাপড়ের মাস্ক।
মাস্ক প্রস্তুতকারক মাস্ক ইউ ডট স্টুডিও (www.maskyou.studio)-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের তৈরি মাস্ক কেবল মুখে সেঁটে থাকা একটা আবরণ নয়, বরং মহামারির এ বিষণ্ন সময়ে মুখোশের আড়ালে ঢেকে যাওয়া মানুষের মুখরতার গল্প। মুখোশের আড়ালের মানুষটির পরিচয়, আবেগ-অনুভূতি, জীবনভাবনা, ভালোবাসাকে ধারণ করে থাকার গল্প হয়ে উঠতে পারে মুখোশ, তাই মুখোশকে এক অনির্বচনীয় আবেশের গল্প বলে মনে করেন তাঁরা। তাঁরা উপলব্ধি করেন, এখন মুখোশ মানে বাঁচার আকুতি, প্রাণের স্পন্দন। মাস্ক ইউর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব আলম বলেন, বিজ্ঞানের সঙ্গে ফ্যাশনের দিকটি মিলিয়েই একটু ভিন্ন ধাঁচের মাস্ক এনেছে মাস্ক ইউ, যা আগ্রহ নিয়েই পরছেন সাধারণ মানুষ, এমনকি শিশুরাও। বাড়তি একটা কার্বন ফিল্টারের স্তরও থাকছে (পিএম ২.৫) তাঁদের মাস্কে। যদিও মাস্ক পরে থাকার অনভ্যস্ততার কারণে অনেকেই মাস্ক পরে থাকতে চান না। সুন্দর নকশার মাস্ক মানুষকে এ অনভ্যস্ত কাজেও অভ্যস্ত করে তুলতে পারে। দেশজ সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য যেমন আসছে মাস্কে, তেমনি বৈশ্বিক ধারার আধুনিক নকশাও দেখা যাচ্ছে। রিকশাচিত্র যেমন রয়েছে, ‘সুপারহিরো’ থিমও বাদ যায়নি।
মুখোশের উদ্যোগ-পেছনের গল্প
রেনে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান ডিজাইনার সানজানা জামান বলেন, করোনাকালের শুরুর দিকে মাস্ক সংকটের সময় একরঙা মাস্ক তৈরি করেছিলেন তাঁরা। সেটি ছিল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজের অংশ। ধীরে ধীরে রঙিন ও ফ্যাশনেবল মাস্ক নিয়ে এসেছেন তাঁরা। মাস্কের ভেতরের স্তরের শোষণক্ষমতা যাতে ভালো হয়, মাস্কটি যাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয় ও মানসম্মত হয়, তা নিশ্চিত করেন তাঁরা। আবার মাস্কের বাইরের অংশটা পানিরোধী, এমন মাস্কও এনেছেন তাঁরা। দেশীয় মোটিফে তৈরি মাস্কগুলো বেছে নিতে পারেন পোশাকের সঙ্গে মিলিয়েও।
তিন বোনের অনলাইন উদ্যোগ ত্রয়ীজ ক্লদিং। তিনজনের একজন ফাইরিন ফরিদ। স্বাস্থ্য সুরক্ষা, আরাম আর ফ্যাশন—তিন দিক মাথায় রেখেই মাস্ক এনেছে ত্রয়ীজ ক্লদিং।
সাধারণ মানুষের জন্য কাপড়ের মাস্ক ভালো
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শামীম আহমেদ বলেন, ‘কাপড়ের মাস্ক শতভাগ সুরক্ষা দেবে না, তবে দৈনন্দিন প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে গেলে সাধারণ মানুষের জন্য কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করা ভালো। কারণ, আমরা এখনো জানি না কবে আমরা আবার আগের মতো চলতে-ফিরতে পারব। একটি পরিবারের তিন–চারজনের জন্য প্রতিদিন দুটি করে মাস্কও যদি কিনতে হয়, বাস্তবিক অর্থে সব পরিবারে তা কার্যকর করা অসম্ভব বলা যায়। তার চেয়ে ভালো হয়, যদি পরিবারের সবার জন্য কয়েকটি করে কাপড়ের মাস্ক থাকে।
নকশায় বৈচিত্র্য
মাস্ক যখন ফ্যাশনের অনুষঙ্গ, তখন মাস্কেই থাকতে পারে নানান নকশা। জামদানি প্রিন্ট, গামছা প্রিন্টসহ অন্যান্য ধাঁচের প্রিন্ট রয়েছে বাজারের মাস্কে। পলকা ডট, চেক, ডোরাকাটা নকশাসহ নানা প্যাটার্নের ব্যবহার রয়েছে। মোমবাটিকও মিলবে। ফুল, প্রজাপতি, মোমবাতি, পতাকার ‘থিম’ সবই উঠে আসছে এখনকার মাস্কে। কেউ পছন্দ করেন ভেজিটেবল ডাই। কেউ চান একরঙা মাস্ক। কেউ চান ‘করপোরেট লুক’। পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে মাস্ক বেছে নিতে পারেন। শিশুদের পছন্দসই রঙিন; ফুল-ফল, গাড়ি কিংবা কার্টুন চরিত্রভিত্তিক মাস্কও পাবেন। কোথাও আবার মাস্ক পাবেন মিলিয়ে—সন্তান ও অভিভাবকের জন্য, যাতে শিশু মাস্ক পরতে উৎসাহ পায়।
অরণ্যর জ্যেষ্ঠ ডিজাইনার সৈয়দা ফারজানা হোসেন জানালেন, ফুলেল মোটিফ, জ্যামিতিক মোটিফে মঞ্জিত, ইন্ডিগো, জলপাই, ধূসর, সোনালি, বাদামিসহ নানান রঙের মাস্ক এনেছেন তাঁরা। প্রাকৃতিক রঙের বাহারি মাস্কে রয়েছে বিপরীত রঙের পাইপিংয়ের ব্যবহার। তাঁদের শোরুমের মাস্কে থাকছে ফিতা। ফিতার নকশায়ও রয়েছে বৈচিত্র্য। চাইলে ইলাস্টিকযুক্ত মাস্ক নেওয়ার সুযোগও রয়েছে।
ক্লাবহাউসের জ্যেষ্ঠ ডিজাইনার ফারজানা খানম সামিয়ার কাছে জানা গেল, সুতি কাপড়ে কুইল্ট ডিজাইনের মাস্ক আনছেন তাঁরা। সাদা মাস্কই বেশি তাঁদের আয়োজনে। তবে একরঙা মাস্ক রয়েছে অন্যান্য রঙেরও। চাইলে পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে যেকোনো একটি রং বেছে নেওয়া যেতে পারে।
সারা লাইফস্টাইল লিমিটেডের ডিজাইন বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক শামীম রহমান জানালেন, কারচুপি কাজ করা মাস্ক রয়েছে তাঁদের। এ ধরনের মাস্ক পরিষ্কার করার সময় অবশ্য একটু সতর্কতা প্রয়োজন। ড্রাই ওয়াশ করাতে পারলে ভালো, নইলে হালকা ধরনের শ্যাম্পু দিয়ে খুব সাবধানে ধুয়ে নিন, যাতে নকশার ক্ষতি না হয়।
সব দিক ঠিকঠাক
মুখের আকার অনুযায়ী মাস্কের আকার বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকছে কোথাও কোথাও। আবার মাস্কের পেছনের অংশ সুবিধাজনক উপায়ে ‘ফিট’ করার বা সামঞ্জস্য রাখার ব্যবস্থাও থাকতে পারে। শিশুর বয়স ও মুখের গঠনভেদে ভিন্ন আকারের মাস্ক প্রয়োজন হয়। আজকের দিনে এভাবেই ফ্যাশনও হোক স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি। এমন মাস্ক বেছে নিন, যা দীর্ঘ সময় পরে থাকলেও অস্বস্তি না হয়।
কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করতে চাইলে কোন কোন বিষয় খেয়াল রাখতে হবে? প্রশ্ন রাখি তাঁর কাছে। জানা গেল অনেক কিছু—
যেখান থেকেই মাস্ক কিনুন না কেন (কিংবা পুরোনো কাপড় দিয়েও যদি নিজে বানিয়ে নেন বাড়িতে), তিন স্তরের কাপড়ে বানানো মাস্ক বেছে নিন অবশ্যই।
একটি মাস্ক সর্বোচ্চ টানা চার ঘণ্টা ব্যবহার করাই আদর্শ নিয়ম। তবে সব দিক বিবেচনা করে আট ঘণ্টা পর্যন্ত একটি মাস্ক একটানা ব্যবহার করাটাও গ্রহণযোগ্য বলে ধরা হয়।
মাস্ক পরার আগে এবং পরে নিয়মমাফিক হাত ধুতে হবে (সাবান-পানি না পেলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যাবে)।
একবার মাস্ক পরে নিলে মাস্কের সামনের অংশে আর হাত দেওয়া যাবে না। খোলার সময় কেবল পেছন থেকে স্ট্র্যাপ বা ইলাস্টিকের অংশটাই স্পর্শ করুন।
খাওয়া-দাওয়া বা অন্য প্রয়োজনে মাস্ক যদি খানিকক্ষণের জন্য খুলে রাখতে হয়, তাহলে তা একটি পরিষ্কার কাগজের ওপর রাখুন। একই কাগজ বারবার ব্যবহার করবেন না। পুনরায় মাস্ক পরার সময় কেবল স্ট্র্যাপ বা ইলাস্টিকের অংশই স্পর্শ করুন, প্রথমবার পরার সময় যে অংশ বাইরের দিকে ছিল সেটা বাইরের দিকেই রাখুন।
মাস্ক ব্যবহার শেষে সেটি খুলে রাখুন একটি প্যাকেটে (কাগজের ঠোঙা হতে পারে)। প্যাকেটের মুখ মুড়ে রাখুন। প্যাকেটে রাখার অন্তত পাঁচ দিন পর মাস্ক বের করে নিয়ে কুসুম গরম পানি কিংবা সাধারণ তাপমাত্রার পানি এবং সাবান বা ডিটারজেন্টের সাহায্যে পরিষ্কার করে নিন (ধোয়ার আগে ১০-২০ মিনিট সাবান বা ডিটারজেন্ট-পানিতে ডুবিয়ে রাখুন)।
বাইরে থেকে মাস্ক বা মাস্কের জন্য কাপড় কেনা হলে সেটিও বাসায় আনার পরপরই অন্তত পাঁচ দিনের জন্য একটা প্যাকেটে রেখে এরপর ধুয়ে নেওয়া উচিত।
ধোয়ার পর মাস্ক শুকালে ইস্তিরি করে নেওয়া ভালো।
সপ্তাহের দিনভিত্তিক সাতটি মাস্ক রাখতে পারেন এক একজনের জন্য। তাহলে একটি মাস্ক পাঁচ দিনের জন্য প্যাকেটে রেখে দেওয়ার সময়টাতে অন্য মাস্ক ব্যবহার করা যাবে।