সাহিদা পেরেছে, অন্যরা কেন পারবে না
চর রাজিবপুরকে কুড়িগ্রামের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। প্রত্যন্ত এই চরের অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান সাহিদা আক্তার। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় পরিবার থেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য জোর করতে থাকে। সে গোঁ ধরে, ‘এখন আমি কিছুতেই বিয়ে করব না। লেখাপড়া করতে চাই।’ শেষ পর্যন্ত মেয়ের জেদের কাছে হার মানে পরিবার। সেই মেয়ে এখন কলেজে পড়ে। সাহিদা নিজের বিয়ে বন্ধ করতে পারলেও করোনাকালে জেলায় হাজারো কন্যাশিশু বিয়ের শিকার হয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও আরডিআরএস বাংলাদেশ জানায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত জেলার ৯টি উপজেলায় ৩ হাজার ২৬৯টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ হয়েছে ১ হাজার ১৭৫টি। তাদের মধ্যে ১ হাজার ১৪৫টি মেয়ে ও ৩০ জন ছেলে। লেখাপড়া করছে ৪৫৮ জন।
কুড়িগ্রামকে বাল্যবিবাহমুক্ত জেলা করতে ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থিত সুইডেন দূতাবাসের অর্থায়নে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহযোগিতায় আরডিআরএস বাংলাদেশ বিল্ডিং বেটার ফিউচার ফর গার্লসের (বিবিএফজি) মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত কাজ চলবে।
এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে জেলায় ১৫ বছরের নিচে বাল্যবিবাহের হার শূন্যে নামিয়ে আনা এবং ১৮ বছরের নিচে বাল্যবিবাহের হার এক–তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা। প্রকল্পের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ইমাম, ঘটক ও পুরোহিত প্রশিক্ষণ, চ্যাম্পিয়ন ফাদার নির্বাচন, স্কুল পর্যায়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, যুব বিতর্ক, স্কুলপর্যায়ে কর্মশালা ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময়। এসব কাজের কারণে বিবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা বাল্যবিবাহের কুফলসহ প্রচলিত আইনে এর শাস্তির বিধানগুলো সম্পর্কে অবগত হচ্ছেন। এ ছাড়া জেলার ৯ উপজেলায় ৭৬টি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে ৬৮৪টি শিশু সুরক্ষা কমিটি আছে। এর প্রধান হচ্ছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য। এ কমিটি শিশু সুরক্ষা, বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করে।
উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া ৭ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি আনোয়ার খান বলেন, ‘শিশু সুরক্ষা কমিটির তৎপরতায় এ ওয়ার্ডে দুটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা গেছে। আমরা বাল্যবিবাহের কুফল নিয়ে গণনাটক ও ভিডিও প্রদর্শন করে থাকি। জেলার ৭৬টি ইউনিয়ন ও ৩টি পৌরসভার প্রতিটিতে যুব ফোরামের ৩৬ সদস্যের কমিটি রয়েছে। এরা নিয়মিত সভা সমাবেশ ও বাল্যবিবাহের খবর সংগ্রহ ও বন্ধে কাজ করে। এ ছাড়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটি রয়েছে। কমিটি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও রোধে প্রচার–প্রচারণা চালায়। প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে ৬৮৪ জন চ্যাম্পিয়ন বাবা রয়েছেন, যাঁরা ওয়ার্ড পর্যায়ে সচেতনতামূলক কাজ করছেন এবং বিয়ে বন্ধে ভূমিকা রাখছেন।
রৌমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বারবান্দা গ্রামে ফজলুল করিম এ রকমই একজন চ্যাম্পিয়ন বাবা। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি ভারত সীমান্তসংলগ্ন দুর্গম এলাকায়। এখানে অনেক বাল্যবিবাহ হতো। এর কুফল আমি বুঝতে পেরে এগুলো বন্ধে মানুষকে সচেতন করি। শুক্রবার জুমার খুতবার সময় সচেতনতামূলক বক্তব্য দিই। এসব কারণে আরডিআরএস আমাকে চ্যাম্পিয়ন বাবা ঘোষণা করে।’ তিনি ইতিমধ্যে দুটি বিয়ে রোধে করেছেন। এ ছাড়া চার হাজার ঘটক, ইমাম ও পুরোহিতকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা শপথ করেন, নিজেরা ১৮ বছরের নিচে বাল্যবিবাহ পড়াবেন না এবং বিয়ে বন্ধে ভূমিকা রাখবেন। ২৫৭টি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় মেয়েশিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটি রয়েছে। কমিটির সদস্যরা প্রতি মাসে বাল্যবিবাহ রোধ ও সচেতনতা সভা সমাবেশ করেন।
আর এসবের সুফল পাওয়া শুরু হয়েছে। জরিপের তথ্য বলছে, জেলায় বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমছে। ২০১৭ সালে জেলায় ১৮ বছরের নিচে বাল্যবিবাহ হতো ৬৫ শতাংশ। ১৯ সালে কমে ৪৬.৮ শতাংশ। অপর দিকে ২০১৭ সালে ১৫ বছরের নিচে বিয়ে হয় ১৭ ও ১৯ সালে ১২.৪ শতাংশ। অপর দিকে ২০১৯ সালে জেলায় প্রতি মাসে গড়ে বাল্যবিবাহ হয়েছে ৯৪টি, ২০২০ সালে ২০টি ও ২০২১ সালে ৩১টি। ৬ ডিসেম্বর রাজারহাট উপজেলাকে প্রাথমিকভাবে বাল্যবিবাহমুক্ত করা হয়েছে। এর আগে ৫৮টি ইউনিয়নকে প্রাথমিকভাবে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হয়। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে ঘোষণা করা হবে।
প্রকল্প সমন্বয়কারী আবদুল্লা আল মামুন জানান, ঘটক, কাজি, ইমাম ও পুরোহিতেরা প্রত্যক্ষভাবে বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িত। তাঁদের সচেতন করতে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় পাঁচ বছরে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক সমস্যা। কুড়িগ্রামে এর প্রবণতা অনেক বেশি। এককভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এটি রোধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।