সাদা-কালো ছবির চ্যালেঞ্জ কেন
অনলাইনের এই যুগে বাইটে ভর করে মুহূর্তে কোনো চলতি ধারা (ট্রেন্ড) সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেয়। ফ্যাশন ট্রেন্ডে ভৌগোলিক জাতপাত, সংস্কৃতি, খরচপাতির বিষয় চলে আসে সামনে। তাই ইচ্ছে, কখনোবা অর্থ থাকলেও চলতি ধারায় শামিল হতে সাতপাঁচ ভাবতে হয়। সে ক্ষেত্রে তথ্যকেন্দ্রিক ডিজিটাল ট্রেন্ডে যুক্ত হওয়ার জুড়ি নেই। শুধু হ্যাশট্যাগ (#) দিয়েই তাতে যুক্ত হওয়া যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো একটি ইস্যুতে সচেতনতা তৈরি বা প্রতিবাদ জানাতে হ্যাশট্যাগের রাজত্ব চলছে।
করোনাভাইরাস মহামারির ঘরবন্দী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘিরে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নানা হ্যাশট্যাগ আয়োজন ঘুরেছে। এখনো ঘুরছে। সাজ, পোশাক, রান্না, বই পড়া, ভ্রমণ, কবিতা, গল্প, গান সব শাখায় ছিল হ্যাশট্যাগ। সবশেষ এই হ্যাশট্যাগে যুক্ত হয়েছে সাদা–কালো ছবির চ্যালেঞ্জ। নারীর ক্ষমতায়ন ইস্যুতে ‘চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপটেড’ শিরোনামে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে পাশের দেশ ভারতে এই হ্যাশট্যাগে বিপুলসংখ্যক তারকা যুক্ত হয়েছেন। তারকাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন সাধারণ মানুষও। আমাদের দেশেও অনেকে এতে যুক্ত হয়েছেন। কেউ হ্যাশট্যাগ যুক্ত করে মূল চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়েছেন। কেউ শুধুই সাদা–কালো ছবি দিয়েছেন।
সমালোচকেরা বলছেন, বর্ণবাদ আর কোভিড–১৯ মহামারি এই দ্বৈত সংকটের মধ্যে এই চ্যালেঞ্জ এক উৎপাত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ফিড ছেয়ে যাচ্ছে জঞ্জালে। তাঁদের মতে, নারীর ক্ষমতায়ন বা নারীর প্রতি অন্যায়ের বিচার চাওয়ার উদ্দেশ্যে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ অর্থহীন। তাঁদের মতে, সামাজিক বিচার যখন একটু নিশ্বাস পেতে লড়াই করছে, তখন এ ধরনের কর্মকাণ্ড বিভ্রান্তিকর। তবে চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণকারীরা এটাকে চলমান সংকটের মধ্যে একটু দম ফেলার ফুরসত হিসেবে দেখছেন।
কেন এই চ্যালেঞ্জ
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ফেসবুক মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রাম ভেসে যায় তারকাদের সাদা–কালো সেলফি বা পেশাদার আলোকচিত্রীর হাতে তোলা ছবিতে। নারীর ক্ষমতায়নে সংহতি প্রকাশ হিসেবে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট চ্যালেঞ্জ (#blackandwhitechallenge), চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপটেড (#challengedaccepted), উইমেন সাপোর্টিং উইমেন (#womensupportingwomen) শিরোনামে চলেছে সাদা–কালো ছবি পোস্টের রাজত্ব। এটি শুধু নারীদের ঘিরেই হচ্ছে। একজন নিজের সাদা–কালো ছবি পোস্ট করে অপর এক বা একাধিক নারীকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে ট্যাগ করেছেন।
যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে হ্যাশট্যাগ মিটু (#MeToo) আন্দোলনের পর সাদা–কালো ছবির এই চ্যালেঞ্জে নারীদের ব্যাপক হারে সংহতি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ২০০৬ সালে অধিকারকর্মী তারানা বার্কের আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর টুইটারে মার্কিন অভিনেত্রী আলিসা মিলানো মিডিয়া মোগল হার্ভে উইস্টিনের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীর পক্ষে প্রতিবাদ হিসেবে এই অনলাইন আন্দোলন শুরু করেন। অনলাইন আন্দোলনে হ্যাশট্যাগ মিটু এক ইতিহাস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রথম ২৪ ঘণ্টায় এই হ্যাশট্যাগে ১ কোটি ২০ লাখ পোস্ট হয়।
#blackandwhitechallenge–এ ইনস্টাগ্রামে পোস্ট হয়েছে ১০ লাখ ৯২ হাজার ৯৭৪টি। #challengedaccepted–এ ইনস্টাগ্রামে পোস্ট হয়েছে ৬৫ লাখ ৫৭ হাজার ১৩টি। #womensupportingwomen–এ ইনস্টাগ্রামে পোস্ট হয়েছে ৮৬ লাখ ৭০ হাজার ৬৪০টি।
তবে শুরুতে এটা স্রেফ নির্দোষ পোস্ট বলে বিবেচিত হলেও পরে এটা নিয়ে বিতর্ক ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে। যুক্তরাষ্ট্রে ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী নারীর ক্ষমতায়ন ইস্যুতে চ্যালেঞ্জটিতে অংশ নেওয়া শুরু করলে চ্যালেঞ্জের উৎপত্তিস্থল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
অনেকের দাবি ছিল, এ চ্যালেঞ্জের শুরু তুরস্কে। সাবেক প্রেমিকের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী পিনার গুলতেকিন (২৭) হত্যার প্রতিবাদে গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে তুরস্কে এই সাদা–কালোর ছবির চ্যালেঞ্জ শুরু হয়।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদক টেলর লরেঞ্জ প্রথম নিশ্চিত করেন, এই ট্রেন্ড তুরস্কে সৃষ্টি হয়নি। পরে ইনস্টাগ্রামই জানায়, তুর্কি ছাত্রী হত্যার ইস্যুতে নয়, নতুনভাবে এই চ্যালেঞ্জটি শুরু হয়েছে ব্রাজিলে ১৭ জুলাই থেকে। উইমেন সাপোর্টিং উইমেন হ্যাশট্যাগে ব্রাজিলের টিভি সাংবাদিক আনা পাওলা পাদ্রাও নিজের সাদা–কালো ছবি পোস্ট করেন। ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ১০ লাখ।
পরে তুরস্কে ওই চ্যালেঞ্জে পিনার হত্যার প্রতিবাদে সাদা–কালো ছবি পোস্ট হয়। পাঁচ দিন নিখোঁজ থাকার পর তাঁর মৃতদেহ বন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। ২২ জুলাই পিনার হত্যার বিচার চেয়ে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে বিক্ষোভ হয় তুরস্কে। হ্যাশট্যাগে নিজেদের ভাষা যুক্ত করে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা বন্ধে অনলাইন প্রতিবাদ হয়। যার অর্থ ইস্তাম্বুল কনভেনশন কার্যকর করো। হ্যাশট্যাগ পিনার গুলতেকিন (#PinarGultekin) দিয়েও প্রতিবাদ করা হয়।
তবে ইনস্টাগ্রামের এই সাদা–কালো চ্যালেঞ্জটি নতুন নয়। এটি ২০১৬ সালে ক্যানসার সচেতনতায় করা হয়। ইতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ হিসেবে এটি বারবার ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায়।
তারকাদের একে অপরকে চ্যালেঞ্জ
মার্কিন অভিনেত্রী জেনিফার অ্যানিস্টোন, ভায়োলা ডেভিস, গ্যাব্রিয়েলে ইউনিয়ন, ক্রিস্টেন বেল, কেরি ওয়াশিংটন, জেনিফার গারনার, ক্রিস্টেন বেল, এভা লঙ্গোরিয়া, মডেল কোহলে কারদিশান, মডেল সিনডি ক্রোফোর্ড থেকে শুরু করে বলিউডের ক্যাটরিনা কাইফ, কারিনা কাপুর খান, আনুশকা শর্মা, সারা আলী খান, অনন্যা পান্ডে, তারা সুতারিয়া, সোনম কে আহুজা, জারিন খান, বিপাশা বসু, মীরা কাপুর—কে নেই এই চ্যালেঞ্জে। তাঁরা সাদা–কালো ছবি পোস্ট করে অন্য তারকা ও বন্ধুদের এই চ্যালেঞ্জে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাঁদের কারণে এই চ্যালেঞ্জ খুব দ্রুত ভাইরাল হয়েছে। তারকারা প্রত্যেকে এটাকে নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মডেল সিনডি ক্রোফোর্ড নিজের সাদা–কালো ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘একে অপরকে তুলে ধরার এই সহজ উপায়টিকে ভালোবাসুন।’
ক্যাটরিনা কাইফ লিখেছেন, ‘উৎসাহ ও সমর্থন দেওয়ার জন্য আমার চারপাশের সব নারীর প্রতি কৃতজ্ঞ।’ নিজের সাদা–কালো ছবির সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জে তিনি ট্যাগ করেন কারিনা কাপুর খান, আনুশকা শর্মা, ফাতিমা সারা শাইখ ও তাঁর বোন ইসাবেলা কাইফকে।
ক্যাটরিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কারিনা কাপুর খান ছেলে তৈমুর আলী খান পতৌদি ও সোহা আলী খানের মেয়ে ইনায়ার দুটি সাদা–কালো ছবি পোস্ট করে ক্যাপশন লেখেন, ‘ক্ষমতায়ন, সহযোগিতা, ভালোবাসা। তোমার ভেতরের শিশুকে কখনো হারিয়ে ফেলো না।’ এতে তিনি ট্যাগ করেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ও বিদ্যা বালানকে। সারা আলী খান দিয়েছেন তাঁর মা অমৃতি সিংেয়র ছবি।
আনুশকা শর্মা তাঁকে মনোনীত করার জন্য ক্যাটরিনা কাইফসহ চারজনকে ধন্যবাদ জানিয়ে পোস্টে লেখেন, ‘জীবনকে চালাতে আমাদের অনেক বেশি শ্রম, শক্তি, উদ্যম, প্রজ্ঞা, জ্ঞান, ধৈর্য ও সাহস লাগে। কারণ, চারপাশের জগৎ আমাদের জীবনে আকস্মিক পরিবর্তন আনতে চায়। আমাদের চেয়ে এটা ভালো কেউ জানে না। সংহতির সঙ্গে একত্রে থাকা এবং আমাদের জন্য যে ফাঁদ পাতা থাকে তাতে না পড়াটাই আমাদের বিজয়।’
ভারতের কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রকেও দেখা গেছে এই চ্যালেঞ্জে অংশ নিতে। তিনি মা ও কন্যার সঙ্গে নিজের সাদা–কালো ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘হ্যাশট্যাগ উইমেন সাপোর্টিং উইমেন, হ্যাশট্যাগ চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপটেড; এর চেয়ে সাহসী, শক্তিশালী আর আনন্দদায়ক আর কিছু হতে পারে না।’
তবে ক্ষমতায়ন ইস্যুতে না ঢুকে অস্কার মনোনয়নপ্রাপ্ত অভিনেত্রী তারাজি পি হেনসন এই চ্যালেঞ্জকে ‘বোনসুলভ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা শুধু আমার বোনদের ভালোবাসার চ্যালেঞ্জ নয়। এটা উপহার। আমাদের বন্ধন। আমাদের উচিত পৃথিবীতে আমরা যত দিন থাকব তত দিন তা লালন করা। যা–ই ঘটুক, আমরা একসঙ্গেই পথ চলি! অনেক সম্মানিত বোধ করছি! আমার সব বোনকে ধন্যবাদ!’
রান্না প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান ‘টপ শেফ’ এবং ‘টেস্ট অব দ্য নেশন’–এর উপস্থাপক পদ্মলক্ষ্মী চ্যালেঞ্জে যুক্ত হলেও তিনি এতে ভিন্ন ঘটনা যুক্ত করেছেন। গত ১৩ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ নারী ব্রেওনা টেলরসহ আরও তিন কৃষ্ণাঙ্গ নারী হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছেন তিনি।
আমাদের দেশে অভিনেত্রী মিথিলা নিজের সাদা–কালো ছবি পোস্ট করে চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপটেড শিরোনামে যুক্ত হয়েছেন চ্যালেঞ্জে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক একটি মার্কিন বিপণন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ক্রিস্টেন আব্রাহাম বলেছেন, বিষয়টি এখন নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে যুক্ত। হ্যাশট্যাগটি অন্য বড় ইস্যুতে সচেতনতা বাড়াতে বিদ্যমান ছিল। এতে ট্যাপিং দেওয়ার ফলে অংশগ্রহণকারীরা খুব দ্রুত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছেন।
তবে ব্রিটিশ চিত্রনাট্যকার ক্যামেলিয়া ব্ল্যাকেট, প্রযুক্তি উপদেষ্টা ব্রুক হ্যামেরলিং এই সাদা–কালো ছবির চ্যালেঞ্জের কোনো মানে খুঁজে পাননি। তাঁদের মতে, এটা নিজের একটি চোখধাঁধানো ছবি পোস্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়। কোনো নারীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকলে সেই নারীর ছবি দিলেও হতো। অনেকের মতে নিজের সাদা–কালো ছবির পরিবর্তে বই, কোনো পণ্য বা চ্যারিটির ছবি দিলে ভালো হতো।
কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করতে, কিংবা সচেতনতা তৈরি করতে এমন হ্যাশট্যাগ বা চ্যালেঞ্জটি বেশ কার্যকর তা বোঝা যায়, দ্রুতই লাখ লাখ পোস্ট আর কোটি কোটি লাইক দেখে। বিষয়টি তো দুনিয়াজুড়ে আলোচনায় চলে আসে।
তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, বিবিসি, দ্য হিন্দুস্তান টাইমস