সাত সাহসী
ওরা মেধাবী। ওরা যুক্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। যেখানেই বাল্যবিবাহের ঘটনা সেখানেই সোচ্চার তারা সাতজন। ময়মনসিংহের নান্দাইলের এই সাত ছাত্রী গড়ে তুলেছে ‘ঘাসফুল’। সাহসী ভূমিকায় দাঁড়াচ্ছে মেয়েদের পাশে
একই স্কুল। সাতজন ছাত্রী। ময়মনসিংহের নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাত ছাত্রীকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘ঘাসফুল’ নামের এক সামাজিক সংগঠন। এটুকু বললেই এদের কাজ বোঝা যাবে না। শিক্ষার্থীরা সামাজিক কাজ করে, অনেকের সংগঠনও আছে। কিন্তু এই ঘাসফুলের সাত মেয়ে পরপর তিনটি বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে নিজেদের সাহস দেখিয়েছে সবাইকে। এক সপ্তাহের ব্যবধানেই বাল্যবিবাহের দুটি ঘটনা ঠেকিয়েছে এই মেয়েরা। এর একটি ১৬ এপ্রিলের ঘটনা, আরেকটি ১০ এপ্রিলের। এর আগের ঘটনাটা গত বছরের। বাল্যবিবাহ ঠেকানো ছাড়াও যখনই রাস্তাঘাটে কোনো মেয়ে উত্ত্যক্তের শিকার হয়, তখনই রুখে দাঁড়ায় এই সাত ছাত্রী।
ঘাসফুলের শুরুর কথা
আত্মর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ওয়ার্ল্ডভিশন নান্দাইল কার্যালয়ের হাত ধরে ঘাসফুলের জন্ম। লেখাপড়া সামাল দিয়ে এর সাত সদস্য বাল্যবিবাহ ঠেকানোর কাজ করে যাচ্ছে। আর ছাত্রীদের এসব উদ্যোগ প্রশংসিত হচ্ছে অনেকের কাছেই।
ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের উত্তর পাশে নান্দাইল উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয়। এর উল্টো দিকেই নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। ঘাসফুলের সাত সদস্য এই বিদ্যালয়েরই ছাত্রী। নবম শ্রেণিতে পড়ে তুলি দেবনাথ, সানজিদা ইসলাম ও স্নেহা বর্ম্মণ এবং অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী লিজুয়ানা তাবাসসুম, জান্নাতুল ইসলাম, জীবননিসা খানম ও জান্নাতুল আক্তার। গত বছর এদের নিয়ে গঠিত হয়েছে ঘাসফুল।
ঘাসফুলের কেউ কেউ মা-বাবার সঙ্গে পৌর এলাকায় থাকে, আবার কারও বাড়ি একটু দূরের গ্রামে। সেখান থেকে বিদ্যালয়ে আসে। সাত ছাত্রীর সবাই মেধাবী। আর সাহসী তো বটেই। লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ-গান, বিতর্ক, বক্তৃতা, উপস্থিত অভিনয়, গিটার বাজানো, স্কাউটিং, ছবি আঁকা নানা বিষয়ে পারদর্শী একেকজন। কেউ তাদের ঘাঁটাতে সাহসও পায় না। আবার এই সাহসিক অবস্থানের কারণে পরিবারের সদস্যরা মেয়েদের নিয়ে কিছুটা চিন্তায়ও থাকেন।
সাহসীদের সাতকাহন
ঘাসফুলের একজন তুলি দেবনাথ। ১০ এপ্রিল সে খবর পায় নান্দাইল পৌরসভার দশালিয়া মহল্লার নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ের আয়োজন চলছে। তুলি বলে, ‘আমরা সবাই মিলে ঘটনাটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল খালেক স্যারকে জানাই। পরে তিনি আমাদের লেখা এক আবেদনপত্রে সুপারিশ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠান। পরদিন সেখান থেকে মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা রোমানা আক্তারকে আমাদের সঙ্গে পাঠানো হয়।’ এরপরই এই বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়। তুলি বলে, ‘সমাজের জন্য ভালো কাজ করছি। এই প্রেরণা থেকেই ঘাসফুলে জড়িত হয়েছি। এখন দেখছি মানুষ আমাদের নিয়ে ভাবছে। আমাদের কাজে সমর্থন দিচ্ছে। কেউ কেউ অসন্তোষও প্রকাশ করে।’ তুলি অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে। সে বৃত্তিও পেয়েছে। নাচের প্রতিযোগিতায় সে জেলা পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
সানজিদা ইসলাম উপস্থাপনা করতে ভালোবাসে। এ ছাড়া নাচ, গান ও অভিনয়ও করে সে। সানজিদা বাল্যবিবাহের ঘোর বিরোধী। যেভাবেই হোক এ রকম বিয়ে ঠেকাতে চায় সে। পড়ালেখা শেষ করে সেনা কর্মকর্তা হওয়ার ইচ্ছা তার। গতকাল সোমবার সে প্রথম আলোকে বলে, ‘আমাদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। এই তো পরশু (১৬ এপ্রিল) এক সহপাঠী জানায় আচারগাঁও ইউনিয়নের চানুপর গ্রামের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। ওই গ্রামে যাওয়ার পর ছাত্রীর পরিবারের লোকজন আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। পরে আমরা ইউএনওকে জানাই এবং পুলিশের সহায়তা নিয়ে ওই ছাত্রীর বাল্যবিবাহ বন্ধ করি।’
ঘাসফুলের আরেক সদস্য স্নেহা বর্ম্মণ বিচার বিভাগে কাজ করতে চায়। নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করে যারা তাদের আইনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে চায়। সে গিটার বাজাতে পছন্দ করে।
লিজুয়ানা তাবাসসুম মেধাবী ছাত্রী। নান্দাইল সদর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে তার বাড়ি। ও বলে, ‘গ্রাম থেকে সে একাই বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করি।’ কাউকে ভয় করার মতো মেয়ে সে নয়। লিজুয়ানার কথা, ‘অন্যায় না করলে কিসের ভয়। আমরা সাতজন তো কোনো অন্যায় করছি না। কোনো ছাত্রী রাস্তাঘটে উত্ত্যক্তের শিকার হলে আমরা এগিয়ে যাই। প্রতিরোধ করি। এটাই তো আমাদের শপথ।’
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল ইসলাম মনে করে মুখ গুঁজে শুধু পড়ালেখা করলেই মেয়েদের সব সমস্যার সমাধান হয় না। প্রতিবাদ করতে না শিখলে আমাদের দেশের মেয়েদের নির্যাতিত হতে হবে। সে সাইকেল চালাতে পছন্দ করে।
২০১৬ সালে খামারগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে বিয়ে করার জন্যে পরিবারের ওপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করে প্রতিবেশী এক তরুণ। সে আবার বহু বিবাহে আসক্ত। এ খবর আসে ঘাসফুলের সদস্য জীবননিসা খানমের কাছে। এরপর ঘাসফুলের সাত সদস্য ওই এলাকায় গিয়ে প্রতিবাদ করে বাল্যবিবাহটি আটকে দেয়। জীবননিসা খানম সেলাইয়ের কাজ ভালো জানে। বিতর্ক, অভিনয় ও বক্তৃতাও করে নিয়মিত। জীবননিসা বলে, ‘নির্ভয়ে কাজ করে চলেছি। ওয়ার্ল্ডভিশন আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে শিখিয়েছে। আমরা সাতজন সামাজিক কাজ করে যাচ্ছি।’
জান্নাতুল আক্তার উপজেলার মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের কানুরামপুর গ্রাম থেকে নান্দাইলে আসে। ঘাসফুলকে নিয়ে সে গর্ববোধ করে। পড়া-লেখা শেষ করে সে সরকারি চাকরি করতে চায়।
মান্যজনদের প্রশংসা ও সমর্থন
ঘাসফুলের এই সাতজনের কাজের প্রশংসা এলাকার অনেকেই করেন। নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল খালেক বলেন, ‘আমাদের ছাত্রী হিসেবে নয়, ঘাসফুলের সদস্য এই সাতজন আসলেই মেধাবী। শহরের মতো আমাদের গ্রামীণ সমাজ ততটা এগোয়নি। এই সমাজে নারীরা এখনো অসহায়। সেই সমাজের মেয়ে হয়ে ওরা পথেঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত হতে দেখলে প্রতিবাদ করছে। বাল্যবিবাহের খবর পেলে অভিভাবকদের বলেকয়ে বিবাহ বন্ধ করছে। এসব উদ্যোগ তো বয়স্করা নিতে সাহস পান না। কিন্তু ওরা পায়।’
সানজিদা ইসলামের মা লিজা আক্তার জানালেন তিনি নিজেও এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদ করতেন। তাই এই মেয়েদের কাজে তিনি সমর্থন দেন।
উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির (দুপ্রক) সভাপতি গাজী আবদুল সালাম ভূঁইয়া বীর প্রতীক বলেন, এই মেয়েরা সমাজের নানা অসংগতি ও বৈরিতার সঙ্গে যুদ্ধ করছে।
নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ঘাসফুলের মেয়েরা বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে যখনই সহায়তা চায়, আমরা তখনই সহায়তা করার চেষ্টা করি।’