তারুণ্যের শক্তি, তারুণ্যের জয়
সহজাত শিল্পী অনিমেষ
বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখা সম্ভাবনাময় তরুণদের নিয়ে প্রতি বৈশাখেই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ‘ছুটির দিনে’। ১৪২৯ বঙ্গাব্দেও ক্রীড়া, অভিনয়, সংগীত, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, গবেষণা, অ্যাডভেঞ্চারে অগ্রগামী ৯ তরুণকে নিয়ে হাজির হয়েছে। এখানে পড়ুন ‘নাসেক নাসেক’ খ্যাত অনিমেষ রায়ের গল্প।
‘দাদা, একটা ছেলের খোঁজ পেয়েছি। দারুণ গানের গলা। “নাসেক নাসেক”নামে ওর একটা গান করতে চাচ্ছি। একেবারে আপনার ঘরানার বলা যায়। এই গানের সঙ্গে আপনাকে কিছু করতে হবে।’ (শায়ান চৌধুরী) অর্ণব যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখনো আমি ছেলেটির নামই শুনিনি। গান শোনা বা দেখা হওয়া তো দূরের কথা। অর্ণবই ‘নাসেক নাসেক’–এর প্রাথমিক রেকর্ডটা আমাকে শোনাল। গানের কথা বা অর্থ কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু সত্যিকারের যা বোঝার, তা বুঝে গেলাম। এমন ভরাট, গমগমে গলা কত দিন শুনিনি! এত সুমধুর সুর, প্রাণদীপ্ত গান! একদম ভেতর থেকে ঝংকার তুলে দেয় যেন।
কোক স্টুডিও বাংলার সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য একটা বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। দেশের নবীন-প্রবীণ সংগীতশিল্পীদের উপস্থিতিতে সব সময় সরগরম থাকত বাসাটি। অনিমেষ রায় গত নভেম্বরের শুরুর দিকে একদিন সেখানে এল। সেই প্রথম দেখা। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। চোখেমুখে শিশুর সারল্য। ভীষণ লাজুক আর বিনয়ী। কথাবার্তায় জড়তা আর সংকোচের ছাপ স্পষ্ট। সত্তাজুড়ে চেনা পাহাড়ি গন্ধ। আমি নিজে পাহাড়ের সন্তান। ফলে একঝটকায় ওকে পড়ে ফেললাম। কেবল পড়ে ফেলা নয়, অনিমেষ যেন খুব দ্রুত মুখস্থ হয়ে গেল আমার কাছে।
অনিমেষ একদম জাত শিল্পী। সরাসরি যখন ওর গান শুনলাম, তখন একটা কথাই আমার মাথায় আসছিল। তা হচ্ছে, ‘র ম্যাটেরিয়াল’। বাংলার মাটি আর জীবন থেকে উঠে আসা যে সংগীত, সেই সংগীতের বিশুদ্ধ কাঁচামাল অনিমেষ রায়। ওর গানে তথাকথিত আধুনিকতার আরোপিত ঝনঝনানি নেই। আছে পাহাড়ি অনার্য সুর। এমন শিল্পী হয়ে জন্মাতে হয়। জন্মে এমন শিল্পী হওয়া যায় না। ওর প্রধান শক্তির জায়গা হচ্ছে ওর সাবলীলতা। এমনিতে সসংকোচ, জড়সড়, কিন্তু যখন গান ধরে, পুরো জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
যত দূর জানি, ও সংগীত পরিবারের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই ঢোল, তবলা, সুর—এসব নিয়ে বেড়ে ওঠা। ব্যাপারটি অনেকটাই এগিয়ে দেয় আসলে। ওর আরেকটি ব্যাপার আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। তা হলো, মাতৃভাষার প্রতি ওর দায়বদ্ধতা। অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা এখন হারিয়ে যাচ্ছে। অনিমেষ নিজের হাজং ভাষাকে তুলে ধরতে চাইছে মানুষের কাছে। যে তন্ময় আনন্দ নিয়ে নিজের ভাষার গানটা ও করে, মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। আমরা সম্প্রতি গিয়েছিলাম ওর এলাকায়। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার বিজয়পুর গারো পাহাড়ের গাঁ ঘেঁষে ছোট ছোট টংদোকান। সেখানে বসে গান-গল্প-আড্ডা। তখন দেখেছি স্থানীয় মানুষেরা ওকে কতটা আপন করে নিয়েছে। ওর আরেকটা বিশেষ শক্তির জায়গা হচ্ছে, গানের বিভিন্ন ঘরানায় ওর সহজাত দখল। কেবল নিজের ভাষার গানই নয়, বাংলা লোকজ গান, এমনকি আধুনিক গানের জন্যও অনিমেষের গলাটা ভীষণ উপযোগী।
এখন আমার বাসায় প্রায় সারা দিনই ওর গান বাজে। আমার স্ত্রী, তিন সন্তান সবাই ওর খুব ভক্ত হয়ে গেছে। আড্ডা, মহড়া, গান—এসবের মধ্য দিয়ে অনিমেষের সঙ্গে বেশ ভালোই সময় কাটছে। প্রতিনিয়তই নতুন অনিমেষকে আবিষ্কার করছি।
এ তো অদ্ভুত একটা সময়। হুট করে কেউ একজন এসে স্টার হয়ে যাচ্ছেন। হারিয়েও যাচ্ছেন যথারীতি। তাই হঠাৎ খ্যাতি পাওয়া শিল্পীদের নিয়ে একটা ভয় আমাদের সব সময়ই থাকে। অনিমেষের ক্ষেত্রে এটা ঘটার সুযোগ কম। শহরের কৃত্রিমতাবিবর্জিত পৃথিবীর মানুষ ও। আলোঝলমলে তথাকথিত তারকা হয়ে ওঠার তাড়না ওর নেই, বরং একজন সত্যিকারের শিল্পী হয়ে ওঠার সাধনা আছে। তা ছাড়া জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের নজরদারিও আছে। ফলে ভুল দিকনির্দেশনায় শিল্পমান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। হারিয়ে যাওয়ার জন্য অনিমেষ আসেনি।
লেখক: সংগীতশিল্পী