সম্প্রীতির মিলনমেলা
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বোয়ালখালী ইসলামিয়া মাদ্রাসা হেফজখানা ও এতিমখানা থেকে বোয়ালখালী নারায়ণ মন্দিরের দূরত্ব মাত্র ৫০ গজ। একই এলাকায় এ দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অবস্থান। দুটি প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ধর্মের হলেও এলাকার স্থানীয় লোকজনের মধ্যে যেন রয়েছে অনন্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এই যেমন বোয়ালখালী নারায়ণ মন্দিরে দুর্গাপূজা ও রাস উৎসবের সময় মুসলিমসহ অন্য ধর্মাবলম্বীরা সহযোগিতা করেন। তেমনি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য বৌদ্ধরাও আসেন এগিয়ে।
আবার পূজার ঘটনাও শুনলাম। মন্দিরে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ, আনসার সদস্যদের তিন বেলা খাবারের দায়িত্ব নেয় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। তেমনি মাদ্রাসায় প্রতিবছর বার্ষিক মাহফিলেও বসে সব ধর্মাবলম্বীর মিলনমেলা। মুসলিম, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের আর্থিক, শারীরিক সহযোগিতায় আয়োজন করা হয় বার্ষিক মাহফিলের। মাহফিলের আগের দিন মাদ্রাসায় হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনকে দাওয়াত দিয়ে খাসি ও মুরগির মাংস দিয়ে মেজবান খাওয়ানো হয়। ২২ বছর ধরে চলে আসছে এমন সম্প্রীতির রেওয়াজ। মাদ্রাসার দেড় শ জন এতিম শিক্ষার্থীর তিন বেলা খাবারের জন্য হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের যাঁদের সরকারি রেশন কার্ড রয়েছে, তাঁরা প্রতি মাসে এক কেজি করে চাল সাহায্য করেন।
২৯ জানুয়ারি ছিল বোয়ালখালী ইসলামিয়া মাদ্রাসা হেফজখানার ২৩তম বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল। আগের রাতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল মেজবানের। হাজির হয়েছিলাম সেই আয়োজনে। বিকেলে মাদ্রাসার পূর্ব দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটি পাতিলে রান্না করছিলেন বাবুর্চি শাহ আলম। তিনি জানালেন, হিন্দু ও বৌদ্ধদের রান্না শেষ হয়ে গেলেই মুসলিমদের রান্না শুরু হবে। হিন্দু ও বৌদ্ধদের জন্য ভাত, খাসি ও মুরগির মাংস আর সবজি রান্না করা হচ্ছে। মুসলিমদের জন্য মহিষের মাংস আর সবজি। চার হাজার অতিথির জন্য রান্নার কাজ চলছে। রান্নার তদারকি করছিলেন বোয়ালখালী (সদর) ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ মোস্তফা। তিনি জানালেন, ১৯৯৮ সাল থেকে মাহফিলের আগের রাতে হিন্দু, বৌদ্ধ ভাইদের দাওয়াত করে খাওয়ানোর রেওয়াজ। সবার সম্মিলিত আর্থিক সাহায্যে মাদ্রাসাটির শিক্ষা কার্যক্রম ও এতিমরা খেতে, থাকতে পারছে। তাই প্রতিবছর মাদ্রাসায় সব ধর্মের মিলনমেলার আয়োজন করা হয়।
রাতে দেখা গেল, আলাদা আলাদা প্যান্ডেলে বসে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সবাই খাচ্ছেন। মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা আবদুল্লাহ মেহেরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন আগত সব সম্প্রদায়ের অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। মাদ্রাসার অন্যান্য শিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যরা আলাদাভাবে খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত। খাবারের পাতিলগুলোও রাখা হয়েছে দুই পাশে। যেন মহিষের মাংসের চামচ খাসি, মুরগি ও সবজির পাতিলের সঙ্গে মিশে না যায়।
তখনই জানলাম, ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ মাদ্রাসার ৬০ জন শিক্ষার্থীকে কোরআন শরিফ উপহার দেয় বৌদ্ধধর্মীয় সংগঠন ত্রিরত সংঘ। বোয়ালখালী ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার পরিচালক মাওলানা আবদুল্লাহ মেহেরীর হাতে কোরআন শরিফ তুলে দিয়েছিলেন বৌদ্ধধর্মীয় গুরু আর্যলোক ভিক্ষু। চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি মাদ্রাসার ৫০ জন শিক্ষার্থীকে কম্বল উপহার দিয়েছে ফেসবুক গ্রুপ সুর ও ছন্দ। কম্বল নিয়ে এসেছিলেন পুলিশের কর্মকর্তা সুব্রত শেখর ভক্ত। তিনি অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা যারা সামর্থ্যবান, সবাই এক প্রকার এতিমদের অভিভাবক। এখানে জাতি, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের বিষয় নয়। মানুষ হিসেবে এতিমদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। সম্প্রীতির মাদ্রাসা হিসেবে এটির নাম শুনেছি, তাই নিজেই এতিমদের জন্য কম্বল উপহার নিয়ে এসেছি।’