সমস্যা যখন ঠোঁটকাটা-তালুকাটা
ঠোঁটকাটা-তালুকাটা মানুষের জন্মগত ত্রুটিগুলোর মধ্যে অন্যতম। অনেক শিশুই ঠোঁটকাটা-তালুকাটা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিছু নির্দেশনা মেনে চললে এবং সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন পদ্ধতি বজায় রাখলে এ ধরনের শিশু জন্ম দেওয়ার ঝুঁকি কিছুটা হলেও কম থাকে। আর সঠিক সময়ে এই জন্মগত ত্রুটির অস্ত্রোপচার করলে শিশুরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তবে ঠিক কখন এই অস্ত্রোপচার করালে তাদের মুখের কথাসহ অন্য বিষয়গুলো ঠিক থাকে, তা অনেকেই জানে না। আবার অনেকে আছে, যারা মনে করে, সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন তা–ই চুপ করে বসে থাকাই উচিত। অনেক পরে চিকিৎসকের কাছে আনে, তত দিনে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়।
ঠোঁটকাটা-তালুকাটা কী?
ঠোঁটের ওপরের অংশ এবং মুখের ভেতরের তালুকাটাকেই ঠোঁটকাটা-তালুকাটা বলে। গর্ভস্থ শিশুর মুখের গড়ন অসম্পূর্ণভাবে গঠিত হলে এ ধরনের সমস্যা হয়।
কী ধরনের হতে পারে?
জন্মের সময়ই শিশুর ঠোঁটকাটা-তালুকাটা ধরা পড়ে। মুখের এক পাশে বা উভয় পাশেই এই সমস্যা দেখা দেয়। শুধু ঠোঁটকাটা থাকতে পারে আবার ঠোঁট থেকে মাড়ির ওপরের অংশ পর্যন্ত কাটা বিস্তৃত হয়। সাধারণত তালুকাটা নাকের নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তালুকাটার ক্ষেত্রে তালুর মাংসপেশি কম কাটা থাকে।
কী ধরনের চিকিৎসা আছে?
সময়মতো প্লাস্টিক সার্জারি বা অস্ত্রোপচার করে এ ধরনের জন্মগত ত্রুটি ঠিক করা যায়। এরপর স্পিচ, হেয়ারিং থেরাপিসহ অন্যান্য চিকিৎসাও রয়েছে, সেগুলো দেওয়া হয়। ঠোঁটকাটা-তালুকাটা চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো শিশুর মুখের স্বাভাবিক গড়ন, শিশুর নিশ্বাস নেওয়া, খাওয়া, কথা বলা এবং শোনার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকলে তা দূর করা। এখন সরকারির পাশাপাশি অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিনা মূল্যে এসব জন্মগত ত্রুটির অপারেশনে সাহায্য করছে।
কখন এই জন্মগত ত্রুটির অস্ত্রোপচার করাবেন?
সময়মতো চিকিৎসা না করালে এসব শিশু নানা ধরনের সমস্যায় ভোগে। যেমন ঠিকমতো খেতে পারে না, খাওয়ার সময় খাবার নাকে উঠে যায়, শ্বাসনালির প্রদাহ হয় ঘন ঘন, শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, শোনার সমস্যাও হয়। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি কমে। আবার সামাজিক, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শেষে যখন কথা শেখে তা নাকের টানে কথা বলা শেখে। ঠোঁটকাটা যদি ওপরের মাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত হয় তাহলে দাঁতেরও সমস্যা দেখা দেয়। ঠোঁটকাটা-তালুকাটার ফলে কথা বলতে বা শব্দ উচ্চারণে সমস্যা হয়।
তাই শিশুদের অল্প বয়সেই যদি এই জন্মগত ত্রুটি ঠিক করা যায়, তাহলে এই শিশুরা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। শুধু নাককাটা শিশুদের সাধারণত ৩-১০ মাসের মধ্যে আর তালুকাটা শিশুদের সাধারণত ৬-১৮ মাসের মধ্যেই এই অস্ত্রোপচার করানো প্রয়োজন। ভালো হয় ১০ মাসের মধ্যে করে ফেললে।
অনেক সময় একাধিক অস্ত্রোপচারেরও প্রয়োজন হয়। তাহলে এই সমস্যা থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এ বয়সের মধ্যে সফল অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হলে এসব শিশু সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। তবে অপারেশনের জন্য শিশুর কিছু পূর্বপ্রস্তুতি আছে। তাই শিশু জন্মের পর যদি এমন সমস্যা ধরা পড়ে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন।
এমন শিশুদের কি ফিডার খাওয়ানো যাবে?
এসব শিশু ফিডার বা চোষণজাতীয় কোনো কিছু ব্যবহার করলে তালুর ফাঁক আরও বেড়ে যায়। এতে অস্ত্রোপচার করতেও বেগ পেতে হয়। সে ক্ষেত্রে চামচ দিয়ে খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রতিরোধ কীভাবে?
এক সন্তানের ঠোঁটকাটা-তালুকাটা সমস্যা হলে পরবর্তী সন্তানেরও এ রকম সমস্যা হতে পারে। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সমস্যা প্রতিরোধ করা যায় না, তবে এ ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা মেনে চলা যায়। যেমন, অল্প ও বেশি বয়সে গর্ভধারণ না করা, গর্ভধারণের আগে এবং প্রথম তিন মাস ফলিক অ্যাসিড সেবন করা, ধূমপান এবং অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার থেকে বিরত থাকা, গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ না খাওয়া।
যাঁদের ঠোঁটকাটা-তালুকাটাসহ শিশুর জন্ম হতে পারে: যাঁদের বংশে কারও ঠোঁটকাটা-তালুকাটার সমস্যা আছে, গর্ভধারণের প্রাথমিক দিকে সিগারেট, মদ এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবনে গর্ভে শিশুর ঠোঁটকাটা-তালুকাটা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে, মা যদি অস্বাভাবিক মোটা হন, মায়ের যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে গর্ভের শিশুর ঠোঁটকাটা-তালুকাটা হতে পারে।
একটি উদ্যোগ
ঠোঁটকাটা রোগীদের সহায়তা করার জন্য স্মাইল ট্রেন নামে আন্তর্জাতিক একটি উদ্যোগ রয়েছে। বাংলাদেশে এই সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (বিপণন) ফজল মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের একটি কল সেন্টার রয়েছে। ০৮০০০৮৮৮০০০ এই নম্বরে বিনা মূল্যে ফোন করে জানালে আমরা ঠোঁটকাটা রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। সেই চিকিৎসাও চলে বিনা মূল্য। দেশের যেকোনো স্থান থেকে যোগাযোগ করা যায়।’ঠোঁটকাটা রোগীকে কাছের নির্দিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে স্কয়ার টয়লেট্রিজ ও স্মাইল ট্রেন।