সন্তানকে মানুষ হয়ে ওঠার সুযোগ দিন
সন্দেহ নেই, আমাদের দেশে তরুণ বাবা–মায়েরা বাচ্চাদের খুব ভালোবাসেন, কিন্তু পড়াশোনা শুরু হলে অতিরিক্ত চাপের মধ্যে রাখেন। মায়েদের তখন কাজ হয় স্কুল আর কোচিংয়ে সন্তানকে নিয়ে দৌড়ানো। শুরু হয় নম্বরের পেছনে ছুটে চলার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। স্কুলে প্রথম না হলে জীবনে বড় কোনো ক্ষতি হয় না, বরং লাভ হয় বেশি। ওই অবসরে সে হয়তো জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অন্য কিছু শিখে নিতে পারে।
আমার বড় আপা আমার চেয়ে প্রায় ১০ বছরের বড়। আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, বিয়ে হয়ে চট্টগ্রাম চলে যায় আপা। বাড়িতে আমার বড় তিন ভাই থাকা সত্ত্বেও খুব একা হয়ে যাই। পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো সঙ্গী ছিল না। গণিত ভালোবাসতাম। স্কুলের পাঠ্যবই ছাড়াও বিখ্যাত যাদবচন্দ্রের গণিত ও কালিপদ বসুর বীজগণিত করতাম। আব্বা বলতেন, ‘অঙ্ক শিখতে হলে এসব বইয়ের অঙ্ক করো।’ আব্বা ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংরেজি দৈনিক অবজারভার–এর প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক। আমাদের সঙ্গে বসে আব্বা আইনের বই পড়তেন অথবা পত্রিকার জন্য লেখালেখি করতেন।
আমি পড়াশোনা করেছি ঢাকার কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে। ক্লাসে ১ বা ২ রোল নম্বর থাকত সব সময়। আমার বাবা আমাকে বলতেন, ‘ক্লাসে প্রথম হওয়ার জন্য যদি তোমাকে সারা দিন পড়াশোনা করতে হয়, তাহলে সেটা আমার দরকার নেই। প্রথম সারিতে থাকলেই হবে।’
বিকেলে পড়ার টেবিলে দেখলেই বলতেন, ‘ছাদে গিয়ে হেঁটে আসো। সারা দিন পড়ার দরকার নেই।’ ছোটবেলা থেকেই আমাকে বেশি পড়ার জন্য বকা খেতে হয়েছে, না পড়ার জন্য নয়।
বাবা সব রকম কাজ শেখাতে চাইতেন। গাছ খুব ভালোবাসতেন, বিশাল বাগান ছিল আমাদের গোপীবাগের বাড়িতে। ভোরে উঠে গাছের পরিচর্যা করতেন। আমার নিজের একটা আলাদা গোলাপের বাগান ছিল। এখনো ছাদবাগান করি, বহু ধরনের গাছ আছে আমার।
অবসর সময় যেন আনন্দে কাটে, সে জন্য ১৯৬৫ সালে ৪৫০ টাকা দিয়ে সিঙ্গার সেলাই মেশিন কিনে দিলেন। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম নিজের ফ্রক সেলাই করলাম। বাড়ির সহযোগী মেয়েদের জামা, পেটিকোট, ব্লাউজ সেলাই করতে করতে সেলাইয়ে হাত পাকা হলো।
পরবর্তী সময়ে জাপানে থাকার সময় শেখাটা দারুণ কাজে লেগেছে। খুব সহজেই আমার এবং মেয়ের প্রয়োজনীয় জামা-কাপড় তৈরি করেছি। বাসায় আম্মা বেগম, ললনা এসব সপ্তাহিক ম্যাগাজিন রাখতেন। বেগম–এ আব্বা মজার কোনো রান্নার রেসিপি দেখলে বাজার থেকে প্রতিটি উপকরণ কিনে এনে আমাকে সেটা রান্না করতে বলতেন। তখন পড়তাম সপ্তম শ্রেণিতে।
আমাকে স্কুলের সব রকম সহপাঠ কার্যক্রমে নাম দিতে হতো। খেলাধুলা তো শুধু স্কুল-কলেজে নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ও করেছি। সাংস্কৃতিক সপ্তাহে কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত ও নির্ধারিত বক্তৃতা, ধারাবাহিক গল্প বলা ইত্যাদিতে অংশ নিতাম। ক্যারম, টেবিল টেনিস ছাড়াও ১০০ মিটার, ২০০ মিটার দৌড়, ৪০০ মিটার রিলে রেস, অবস্টাকল রেস, জেভেলিন থ্রো, ডিসকাস থ্রো ইত্যাদিতে অংশ নিতাম।
তবে সবচেয়ে আনন্দের ছিল উপস্থিত বক্তৃতা, আর বিতর্ক প্রতিযোগিতা। আব্বা বলতেন, ‘আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চর্চা করো, নিজের ভুল-ত্রুটিগুলো ধরতে পারবা।’ সেভাবেই চেষ্টা করতে করতে একদিন সেরা বক্তা হয়ে গেলাম।
জাপানে থাকার সময়, ১৯৮৮ সালে জাপানি ভাষায় বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশকে জাপানিদের সামনে পরিচিত করে তুললাম। সোনার মেডেল, ক্রেস্ট এবং মোটা অঙ্কের টাকা পুরস্কার পেলেও সেরা পুরস্কার ছিল লাল-সবুজের এই রূপকথার দেশকে জাপানিদের সামনে তুলে ধরা।
জাপানের নাগোয়া শহরে ছিলাম আমরা। প্রয়োজনে এবং বাবার উৎসাহে সাত দিনের মাথায় শিখলাম সাইকেল চালানো। জাপানে আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা সহজ হয়ে গেল। মেয়েকে পিঠের বেবি ক্যারিয়ারে বেঁধে ডে–কেয়ারে রেখে হাসপাতালে ছুটতাম। এখন প্রতিটি ক্ষণে আমার বাবার কথা মনে করি। সব রকম কাজ শিখিয়ে আমাকে আত্মনির্ভরশীলভাবে গড়ে বিদেশে পাঠানোর সময় আমার বাবা-মায়ের কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। ৫০ বছর আগে আমার বাবা যেটা বুঝতেন, এখনকার আধুনিক বাবা-মায়েদের অনেকেই সেটা বোঝেন না বা বুঝতে চান না! আমার বাবা চাইতেন যে পড়াশোনাটা যেন আনন্দের হয়, জোর করে কুইনিনের মতো গিলিয়ে দেওয়া কিছু নয়।
মানুষের জীবনে আত্মবিশ্বাস যে সবচেয়ে বেশি জরুরি, সেটা মনে হয় আব্বা আমার মধ্যে তৈরি করে দিতে পেরেছিলেন। এখনো দেখি কোনো কাজকেই কঠিন মনে হয় না। ভয় লাগার তো প্রশ্নই ওঠে না।
আমার ছেলেমেয়েদের আমি কখনোই পড়ার চাপ দিইনি। অনেক গল্পের বই কিনে দিতাম। তাই খুব ছোটবেলা থেকেই ওদের মধ্যে বই পড়ার নেশাটা ঢুকে যায়। জাপানে থাকার সময় দেখেছি, শিশুদের প্রতিটি কাজ নিজে করার জন্য উৎসাহ দেয়। দুই বছর বয়সী বাচ্চাকে ডে–কেয়ার থেকে প্রতি সপ্তাহে দুটি বই ধার দেওয়া হতো। তাই বই পড়ার অভ্যাসটা খুব ছোটবেলাতেই মজ্জাগত হয়ে যায়। স্বামী–স্ত্রী আমরা দুইজনই ডাক্তার, তাই ওদেরকে ডাক্তার হতে হবে, এমন চাপও কোনো দিন ওদেরকে দিইনি। নিজেদের চেষ্টায় বুয়েট, আইবিএতে টিকে ওরা বুঝিয়েছে মা–বাবা ওদের সঠিকভাবেই নির্দেশনা দিতে পেরেছে।
তাই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, সন্তানকে মানুষ হয়ে ওঠার সুযোগ দিন, পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিন। জোর-জবরদস্তি বা অতিরিক্ত চাপ নয়; বরং বন্ধু হয়ে, জীবনের শিক্ষক হয়ে পাশে থাকুন। তাহলে সন্তান নিজেই বেছে নেবে জীবনে চলার জন্য সঠিক পথটি।
লেখক: চিকিৎসক