এমটিবি নিবেদিত টপ টক
শেখার আগ্রহ থাকলে অনেকটা এগিয়ে যাবে
স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক এ এইচ এম তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী, ডা. টি এ চৌধুরী নামে তিনি পরিচিত। তাঁর জন্ম ঢাকায়, ১৯৩৭ সালে। বর্তমানে তিনি বারডেম জেনারেল হাসপাতালের স্ত্রী প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রধান। ৯ নভেম্বর এমটিবি নিবেদিত টপ টক অনুষ্ঠানের অতিথি হয়েছিলেন তিনি। প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন মুনির হাসান। সেই সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশিত হলো এখানে।
এখন ৮৩ বছর বয়সেও স্যার আপনি রোগী দেখছেন। একটু আগে জানালেন আজও প্রায় দুই-আড়াই ঘণ্টা আপনি রোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রতিদিন রোগীদের কেসগুলোকে নতুন বলে মনে হয় আপনার? সে জন্য এগুলোকে কি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে পারেন?
হ্যাঁ, চ্যালেঞ্জ তো এখনো আছেই। আসলে প্রত্যেক রোগীই ভিন্ন, যদি আমরা তাদের খুঁটিনাটি বিষয়ে দেখি। একই অভিযোগ নিয়ে আসছে, কিন্তু তার পটভূমি ভিন্ন। সে বিভিন্ন চিকিৎসা পেয়ে এসেছে, তার রোগ অনুসন্ধানেও হয়তো এক একজনের কিছুটা ভিন্নতা আছে। এগুলো আমাদের বুঝতে হবে। একেক রোগী সম্পূর্ণ আলাদা একেকটা সত্তা। মানে একই ফর্মুলা দিয়ে সব রোগীর চিকিৎসা করা যাবে না। সে জন্যই আমি বলছি যে ইন্টারপারসোনাল সম্পর্ক লাগবে, যদি আমরা সফল চিকিৎসক হতে চাই। কিন্তু এ বিষয়টি কমে যাচ্ছে বা হারিয়ে যাচ্ছেও বলা যায়। এটা হওয়া উচিত নয়। আরেকটি বিষয় হলো কাউন্সেলিং। আমরা আগে রোগীকে অনেক সময় দিতাম, তাদের নানা কিছু বোঝানোর জন্য। আজকাল সেটা অত ধৈর্য নিয়ে করি না বা করতে পারি না। আমরা প্রযুক্তির সাহায্য নিই। আমি বলব যে আমাদের চিকিৎসকদের প্রথম যে ধাপ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, সেটা কমে যাচ্ছে। আমরা প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু রোগীর সঙ্গে যোগাযোগের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছি। এই দুটোকে সমন্বয় করতে হবে, যদি আমরা ভালো চিকিৎসক তৈরি করতে চাই। এখন আমরা দেখি অনেক মেডিকেল কলেজ হয়েছে। মেডিকেল কলেজ বেশি বাড়িয়ে, ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বাড়িয়ে কি আপনি গ্রামাঞ্চলে ডাক্তার নিতে পারবেন? পারবেন না। কারণ, তারও তো একটা জীবনের উদ্দেশ্য আছে। তার থাকার জায়গা থাকবে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করার সুযোগ থাকবে, এই ধরনের সুযোগ তো আমরা গ্রামাঞ্চলে তৈরি করতে পারিনি। আমরা কী করে ডাক্তারদের গ্রামাঞ্চলে নেব?
আপনার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, আপনি একজন সেরা শিক্ষক এবং সব সময় চেষ্টা করেন যে আপনার সঙ্গে যে থাকে, তাকে শেখানোর। সেটা আপনি ৫০ বছর আগে যেভাবে করতেন, এখনো সেভাবেই করেন। এই যে শেখানোর একটা রীতি, এটা কেমন করে আপনি অর্জন করলেন?
আমার মনে হয়, ধৈর্য ধরে একজন মানুষকে শেখানোর যে চেষ্টা, সেটা আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। শেখানো এবং জ্ঞান বিতরণ করা প্রত্যেক চিকিৎসকের কাজের একটা অংশ। আমরা অভিজ্ঞতা বাড়াচ্ছি শুধু আমাদের জন্য না। সেই অভিজ্ঞতা আমরা আমাদের জুনিয়রদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। এটা দিতে হলে আমাকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি মনে করি, আমরা যে যেখানে আছি, সেখানে আমাদের দায়িত্ব শুধু রোগীর চিকিৎসা করা না। চিকিৎসার সঙ্গে আরও যারা জড়িত, তাদের আমরা যতটা পারি ওই পরিবেশের মধ্যে প্রশিক্ষণ দিতে, যাতে সেবাযত্নটা আরেকটু ভালো হয়, চিকিৎসা আরও ভালো হয়। এই প্রচেষ্টা আমাদের করা উচিত। বর্তমানে আমরা দেখছি যে এর অভাব হচ্ছে। মানুষ শুধু দৌড়াচ্ছে। কারও সময় নেই। কিন্তু কারও যদি আন্তরিকতা থাকে, তবে মানুষকে শেখানোর জন্য সময়ের খুব একটা অভাব হয় না।
আপনার সম্পর্কে একটা প্রচলিত কথা হলো যে আপনাকে চোখ বন্ধ করে সার্জারির টেবিলে নিয়ে গেলে আপনি অস্ত্রোপচার করে বের হয়ে আসতে পারবেন। এতে আপনার দক্ষতার কথা উঠে আসে। এই পর্যারের দক্ষতা অর্জন করতে প্র্যাকটিস ছাড়াও আর কোন কোন দিকে নজর দেওয়া দরকার?
আসলে আমার তো মনে হয় যে প্র্যাকটিসই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আর খুঁটিনাটির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা অনেক সময় খুঁটিনাটি বিষয়ে মনোযোগ দিই না। কিন্তু যত সূক্ষ্মভাবে আমরা একটা বিষয় পর্যালোচনা করব, তত আমাদের কলাকৌশলের উন্নতি হবে। এ জন্য লাগবে অধ্যবসায়, ধৈর্য। এসব বিষয় যার যার আছে, সে একদম সুপার সার্জন না হলেও মোটামুটি সফল সার্জন হবে।
আপনার সারা দিনের রুটিন কী রকম?
সকালে ওঠার যে অভ্যাস মানুষের থাকে, সেগুলো থেকেই যায়। যেমন কোনো কোনো সময় এমনও হয়েছে যে আমি রাত দুইটা বা তিনটার সময় ঘুমিয়েছি, আবার ঠিক সকাল সাড়ে ছয়টার সময় ঘুম ভেঙে গেছে। এটা অভ্যাসে হয়। তবে যদি ঘুম ভালো না হয়, তখন ক্লান্ত লাগে। এ জন্য চেষ্টা করি ১২টার মধ্যে শুয়ে পড়তে। একটার পর ঘুমাতে গেলে ঘুমটা খুব ভালো হয় না। আমি দুপুরে খাওয়ার পর ঘণ্টাখানেক একটু বিশ্রাম নিই। অনেকে বলে এটা নাকি বদভ্যাস। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। কিন্তু আমি দেখেছি যে বিশ্রাম নিলে পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা আমার কাজ করার শক্তি আরও বাড়ে এবং মনোযোগটা বেশি থাকে।
আপনি তো অনেক ব্যস্ত থাকেন এবং আগে আরও বেশি ব্যস্ত থাকতেন। পরিবারকে কীভাবে সময় দিতেন? আপনার তিন মেয়েকে কীভাবে সময় দিতেন?
আসলে আমরা মোটামুটি একটা ক্লোজ পরিবারই। আমার স্ত্রীর একটা বিষয় আমি বলব, সে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করেছে। কারণ, আমি যখন ইংল্যান্ড থেকে এলাম পাস করে, তখন তার যাওয়ার সময় ছিল। তার সবকিছু ঠিকও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে তার পেশা স্যাক্রিফাইস করেছে। তার ক্লাসে যে ছাত্রছাত্রী ছিল, তাদের মধ্যে সে অন্যতম মেধাবী ছাত্রী ছিল। কিন্তু দিন শেষে সে তার ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করে ফেলে। আমরা চেষ্টা করি পরিবার হিসেবে সব সময় কাছাকাছি থাকার। আমার মেজ মেয়ে বিয়ের পর বাইরে থাকে। তবু রোজ একবার বা সপ্তাহে তিন-চারবার তো ও আসেই। আর দুটো সময় আমরা একসঙ্গে কাটাতে চেষ্টা করি, দুপুরে আর রাতের খাবারের সময়। পারিবারিক বন্ধন আমাদের খুব দৃঢ়, এটা বলতেই হবে। পারিবারিক বন্ধন না থাকলে মানুষের পক্ষে এগিয়ে যাওয়াটাই কিন্তু খুব কষ্টকর।
আপনার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি যে কোনো কোনো অপারেশন আপনি দীর্ঘ সময় ধরে করেছেন। মাঝপথে হাল ছেড়ে না দেওয়ার এই গল্পগুলো কি আপনি নতুন প্রজন্মের জন্য লিখে যাবেন? আত্মজীবনী লেখার কোনো ইচ্ছা আছে?
আমি মনে করি, আমি অত জরুরি মানুষ না আত্মজীবনী লেখার জন্য। তবে একটা বিষয় আশা করব, আমরা যতটুকু আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেছি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও যাতে ওইভাবে কাজ করে। তাদের মধ্যে যেন আন্তরিকতা থাকে, কাজে যেন তারা আনন্দ পায়। আর সব সময় মনের মধ্যে শেখার আগ্রহ থাকতে হবে। এতেই কিন্তু তারা অনেকটা এগিয়ে যাবে। বই পড়ে যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, এটা সব সময় দরকার হয় না। আমি তো ভাবি যে আমি অর্ধেক শিখেছি মানুষকে সঠিক কাজ করতে দেখে, আর অর্ধেক শিখেছি তাদের ভুল কাজ করতে দেখে। তার মানে হলো, একজন মানুষকে আমি যখন অনুসরণ করব, তখন তার ভালো দিক অনুসরণ করব এবং তার খারাপ দিক পরিহার করব। এই লক্ষ্য নিয়ে যদি আমি চলি, তবে আমার শেখার অনেক কিছু আছে এই দুনিয়াতে।