শিশু-কিশোরদের জন্য উপযোগী বই নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে শিশু বইমেলার। মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে বইয়ের সঙ্গে শিশুদের বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়া, আত্মিক একটা সম্পর্ক স্থাপন করে দেওয়া। এই মেলার পাশাপাশি আলোচনা অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে। রঙিন ঝলমলে পোশাক পরা শিশুদের উপস্থিতিতে মুখরিত সেই মেলা প্রাঙ্গণ। তবে অধিকাংশেরই আগ্রহ দেখা যাচ্ছে নাচ-গানের প্রতি। মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে বইমেলায় এসেছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে!
বই কেনার অত সময় তাঁদের নেই, তা ছাড়া বই কিনে শুধু শুধু অতগুলো পয়সা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এর চেয়ে যাওয়ার পথে ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকে কিছু খেয়ে নিলেই হবে!
সাত-আট বছর বয়সী কয়েকটি মেয়েকে দেখলাম নাচের পোশাকেই অর্থাৎ মঞ্চে নাচ শেষ করেই চলে এসেছে বইয়ের দোকানে বই কিনবে বলে। যথারীতি মায়েরাও আছেন সঙ্গে। মেয়েরা উৎসাহ নিয়ে নানা রকম বই নেড়েচেড়ে দেখছিল এবং বাছাই করছিল কিনবে বলে। খুব ভালো লাগছিল বইয়ের প্রতি ওদের আগ্রহ দেখে। কিন্তু একটু পরই শুনতে পেলাম এক মায়ের রাগত কণ্ঠস্বর, খামোখা বই দেখে দেখে এত সময় নষ্ট করছে! মায়েদের তাড়ায় বই না কিনেই মেয়েরা পানসে মুখে বইমেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আহারে! বই আর তাদের কেনা হলো না!
আমরা বলে থাকি, শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। আগামী দিনের পৃথিবীতে জাতিগতভাবে আমরা বিশ্বের কোন স্থানে অবস্থান করব, তা নির্ভর করবে আমাদের শিশুদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে, মেধা-মননে কতটুকু পারদর্শী করে তুলতে পেরেছি তার ওপর। এ বিশ্বে টিকে থাকতে হলে দরকার আলোকিত মানবজাতি। পরিপূর্ণভাবে আলোকিত মানুষ গড়ার বেলায় বইয়ের রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা। ছোটবেলা থেকেই বয়স ও যুগোপযোগী বই যদি শিশুর হাতে তুলে দেওয়া যায়, তাহলে তা অবশ্যই তাদের মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
একটা সময় ছিল যখন কোনো উৎসবে উপহার হিসেবে বইয়ের কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। মধ্যবিত্ত প্রতিটি পরিবারেই এক আলমারি বই বসার ঘরের শোভা বাড়াত। মা-বাবারাও কোনো উৎসব বা জন্মদিনে তাঁদের সন্তানদের বই উপহার দিতেন। এতে ছোটবেলা থেকেই শিশুরা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ার ব্যাপারেও উৎসাহিত হয়ে উঠত।
আজ আর তেমনটি চোখে পড়ে না। সে স্থান এখন দখল করে নিয়েছে নতুন নতুন ডিজাইনের স্মার্টফোন, আইপ্যাড, ল্যাপটপ, নিনটেনডো, প্লে-স্টেশনসহ আরও বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র। যেহেতু তাদের জীবন থেকে খেলার মাঠ চুরি হয়ে যাচ্ছে, তাদের জন্য যথার্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। সেহেতু এসব ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মধ্যেই তারা খুঁজে নিচ্ছে আনন্দ। ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্ব আর ভার্চ্যুয়াল জগতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে কোমলমতি শিশু-কিশোরেরা। এতে শৈশব থেকেই তারা যন্ত্রে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে তাদের সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা ও সহনশীলতা। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সৃজনশীলতা। তাদের কাছে নতুন একটা বইয়ের ঘ্রাণ নেওয়ার চেয়ে নতুন কোনো গ্যাজেটের গন্ধ বেশি ভালো লাগে। কী ভয়াবহ এক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধারেরা! এর প্রমাণ পাওয়া যায় পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই।
শিশু-কিশোরদের পাঠাভ্যাস কমে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। প্রধান কিছু কারণ হচ্ছে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়াকে অভিভাবকেরা উৎসাহিত করেন না। ৫০০ টাকা দিয়ে ফাস্ট ফুড কিনে দিতে কোনো আপত্তি না থাকলেও বই কেনার ব্যাপারে রয়েছে প্রবল আপত্তি! পড়াশোনার ক্ষতির দোহাই দিয়ে বই কেনা থেকে নিবৃত্ত করা হয় সন্তানকে। অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়াকে সমর্থন করেন না। এ ছাড়া রয়েছে যথাযথ পাঠসামগ্রীর অভাব ও দেশি বইয়ের অপর্যাপ্ত মান। বিদেশি ভালো বইয়ের অতিরিক্ত দাম, যা অধিকাংশেরই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। গ্রন্থাগারগুলোর জন্য অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দ, যা হতাশারই উদ্রেক করে।
একমাত্র সমাধান হচ্ছে একেবারে ছোটবেলাতেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। এ জন্য পরিবারকে সবার আগে সচেতন হতে হবে, বিশেষত মাকে। কারণ, পরিবারই হচ্ছে শিশুর প্রথম বিশ্ব ও প্রথম বিদ্যাপীঠ। মা হচ্ছেন তার কেন্দ্রবিন্দু। শিক্ষকদেরও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্য বই পড়ার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা যায়।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, গ্রন্থাগার বিভাগ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ঢাকা।