শিশুর বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে চাইলে

পছন্দ বুঝে বই দিলে শিশুর পাঠ অভ্যাস হবে আনন্দময়। মডেল: নাশিদ ও দুআ
ছবি: অধুনা

তখনো পড়তে শিখিনি, তবু আমার ‘নিজের’ বই ছিল। উপহার পাওয়া বই। মা পড়ে শোনাতেন। বইয়ের জগৎটা যে কী আনন্দের মনে হয়েছিল সেই সময়! আজও আনন্দের রেশটুকু অন্তরের গহিনে। আর এখন? চিকিৎসকজীবনের ‘অন্তহীন’ পরীক্ষার খটখটানি থাকলেও সাহিত্যের বইয়ের পাতা উল্টাই। পছন্দের বই পড়লে পড়ার অভ্যস্ততা থাকবে, তাতে খটমটে পড়ালেখাও চলবে ছন্দিত গতিতে, এমনটাই ভাবনা আমার। বোধ করি ভাবনাটা ভুল নয়।

সুযোগ যেমন

আমার বেড়ে ওঠার মফস্বল শহরটায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি ছিল না বলে আফসোস হতো। স্কুলজীবনের শেষ দিকে সুযোগটা পেয়েছি। বছর দুয়েক পরেই শিক্ষাজীবনের বিস্তৃতিতে সেই শহর ছেড়ে আসতে হয়েছিল। সদস্যপদ বাতিল করিনি, বরং সদস্য অধিকার হস্তান্তর করেছিলাম এক শিশুর কাছে। সপ্তাহে একটি বই পড়ে আবার ফিরিয়ে দেওয়ার অভ্যাসটি দারুণ।

সময়ের মাপকাঠিতে

করোনাকালের শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন অনেকেই। স্কুলের রঙিন দিন হারিয়ে গেছে, পড়ালেখায় অনিয়ম, বাইরে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা। সময় কাটছে টেলিভিশনের পর্দায়, ইউটিউবের ভিডিওতে, ডিজিটাল গেমস খেলে। বড্ড অবিচার হচ্ছে শৈশবের ওপর। বইয়ের অভ্যাসটা গড়েই দেখুন। ধুমধারাক্কা গেমে মজে থাকা অস্থিরমতি শিশু নয়, সে হয়ে উঠবে অনুভূতিপ্রবণ, আবেগীয় গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ। সময় হবে আনন্দময়, ফলপ্রসূ।

বইয়েই হোক আগ্রহ

ইউনিসেফ বলছে, বই পড়ে শিশুর ভাষাগত দক্ষতা বাড়ে, শব্দভান্ডার হয় সমৃদ্ধ। অজানাকে জানা, অদেখাকে মনের চোখে দেখার সুযোগ তো থাকেই। ছোটদের সঙ্গে বই নিয়ে সময় কাটালে তাদের সঙ্গে বন্ধনও দৃঢ় হবে আপনার। শিশু বই পড়তে চায় না? সুকুমার রায়ের একটা ছড়া মজা করে পড়ে শুনিয়েই দেখুন না। বাংলার সমৃদ্ধ শিশুসাহিত্যের প্রতি তাকে আকৃষ্ট করুন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের নন্টে-ফন্টের একটা বই হাতে তুলে দিয়েছেন কি?

যেভাবে আগ্রহ জন্মাবে শিশুর

ছোট্ট থেকেই বই পড়ে শোনান মজা করে, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন আর খানিক অঙ্গভঙ্গিতে শিশুকে আকৃষ্ট করুন। গল্পের আলাদা আলাদা চরিত্রের জন্য কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আনুন, গল্পের মোড় ঘুরলেও কণ্ঠস্বরের পরিবর্তনে তা ফুটিয়ে তুলুন। পড়তে পড়তে কোনো প্রাণীর কথা এলে সেটি দেখতে কেমন, কেমন করে হাঁটে, কেমন করে ডাকে—এসব আলাপও করুন। গল্পের পরের অংশে কী হতে পারে বলে শিশু ভাবছে, এমন প্রশ্নও করতে পারেন ওকে।

  • শিশুর বয়সোপযোগী বই তুলে দিন হাতে। কোমল মনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন বইয়ের জগতের। কোন বয়সে কোন বই দেবেন, বুঝতে না পারলে আত্মীয়-বন্ধুদের সহায়তা নিতে পারেন। তবে আপনার সন্তানের নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হলে, সেই বিষয়ের বই দিন ওকে। নিজের বই নিজে বেছেও নিতে পারে শিশু।

শিশুও বই পড়ে শোনাক আপনাকে। বর্ণ, শব্দ, বাক্য—যতটুকুই হোক, আপনিই ওর কাছে দেখতে চান কতটা পারছে। তবে চাপ প্রয়োগ করবেন না। প্রত্যেকের শেখার দ্রুততা এক নয়। পারস্পরিক ‘পড়া’ বিনিময়ের মাধ্যমে শিশু কথা বলার সময় আত্মপ্রত্যয়ী হবে, শেখার গাঁথুনিও হবে ‘মজবুত’।

  • শিশুরা বড়দের অনুকরণ করতে পছন্দ করে। অভিভাবক নিজেই প্রতিদিন বইয়ের পাতায় সময় কাটাচ্ছেন, এমনটা দেখে বড় হওয়া শিশু বইয়ের দিকে ঝুঁকবে।

  • রোজ বই পড়ার জন্য আলাদা সময় বরাদ্দ রাখুন (১০-১৫ মিনিট হলেও)। শোবার আগে হতে পারে বা অন্য সময়। তবে রোমাঞ্চকর বই ঘুমের আগে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

  • নিত্যনতুন গেমিং উপকরণ না কিনে নতুন নতুন বই এনে দিন ওকে। অনলাইন পরিষেবার মাধ্যমে সন্তানের নামে বই অর্ডার করতে পারেন। নিজের হাতে মোড়কটা খুলে নতুন বই হাতে নিক। ওর নিজের বইয়ের একটা সংগ্রহ দাঁড়িয়ে যাক। অন্য শিশুর সঙ্গে বই অদল-বদল করে পড়া শেষে ফিরিয়ে দেওয়ার অভ্যাস করতে পারেন।