শিশুর ইতিবাচক আচরণ
কিছু শিশু আছে, যারা খুব আদুরে ও প্রাণোচ্ছ্বল। তবে কাছে গিয়ে একটু খাতির জমাতে গেলেই কম্মকাবার। কিছুতেই তাকে নিজের কাছে ঘেঁষানো যাবে না। আবার কিছুটা ভাব জমানোর বাহানায় কোনো উপহার বা চকলেট এগিয়ে দিলেও শিশুটি ধন্যবাদ বা মিষ্টি হাসি—কিচ্ছুটি বিনিময়ে আগ্রহ দেখায় না। এমন পরিস্থিতিতে ভয়ানক বিব্রত হয়ে পড়েন শিশুর মা–বাবা।
আবার কিছু শিশু অকারণেই চিৎকার, চেঁচামেচি, কামড়ে দেওয়া, মারামারি নয়তো ভয়ানক বাজে ভাষায় কথা বলে ফেলে। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারসুদ্ধ সবাই ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। বারবার বুঝিয়ে বলা সত্ত্বেও শিশুর আচরণের খুব একটা উন্নতি হয় না বেশির ভাগ সময়। তবুও শিশু নেতিবাচক কিংবা আগ্রাসী আচরণ করলে ধৈর্য ধরে বারবার বোঝাতে হবে যে তার এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শিশুকে কখনোই আঘাত করা বা মারধর করা উচিত হবে না। শিশুকে দেখাতে হবে যে অভিভাবক হিসেবে আমরা বড়রাও কীভাবে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করি, ঠিক সেটি দেখেই সে তার করা ভুলগুলো বুঝতে পারবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক (সহকারী রেজিস্ট্রার) হাসনা হেনা এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘শিশুর ব্যবহার ও আচরণ বিভিন্ন বয়সে ও পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একেক শিশু একেক রকম আচরণের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। মূলত পারিবারিক আবহ এ ক্ষেত্রে শিশুর আচরণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। শিশুর যেকোনো অস্বাভাবিক আচরণ প্রথম পরিবারের ব্যক্তিদের চোখেই ধরা পড়ে। বিধায় বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন যেকোনো আচরণ দেখলে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়াই ভালো। এতে নিশ্চিত হওয়া যায় সেটি শিশুর স্বভাবগত ব্যাপার, নাকি অন্য কোনো সমস্যার কারণে হচ্ছে।’
তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে মা–বাবাকে সন্তানদের ভালোবাসাময় কোয়ালিটি টাইম দিতে হবে। শহুরে জীবনে কর্মব্যস্ত মা-বাবার পরিকল্পিতভাবে সন্তানকে সময় দিতে হবে। শিশুকে মানুষের সঙ্গে সরাসরি মেশার সুযোগ করে দিতে হবে। কাজের চাপ থাকলেও যতটা সম্ভব সময় দিতে চেষ্টা করতে হবে। বাইরে গেলে, সমবয়সীদের সঙ্গে মিশে সহজেই শিশুর যোগাযোগ ক্ষমতা বাড়তে থাকে। সে মানিয়ে নিতে শেখে সমাজ ও পরিবেশের সঙ্গে।
চিকিৎসক হাসনা হেনার কথার সঙ্গে মিলে গেল গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিশু বিকাশের নার্সারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মওসুফা হকের বক্তব্যও। তিনি বলেন, ‘বাহ্যিকভাবে আমরা শিশুর যে আচরণ দেখি, সেটি সাধারণত পরিবেশের প্রভাব থেকে হয়ে থাকে। মা–বাবার ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। যে কারণে শিশু একা একা অনেকটা সময় কাটাতে বাধ্য হয়। অন্যদের সঙ্গে মেশার সুযোগ কম পেলে কিংবা অন্যদের সঙ্গে কথা বলার পরিবেশ না পেলে শিশুর আচরণে ভিন্নতা দেখা দিতে পারে। অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা করার উৎসাহ না পেলে স্বাভাবিকভাবেই শিশু অন্যের ব্যাপারে ইতিবাচক আচরণ করতে চায় না।’
তাই শিশুকে তার সমবয়সীদের সঙ্গে যতটা সম্ভব মেশার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এতে করে সে তার ভালো লাগা, পছন্দ, অপছন্দ, খেলাধুলা, অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারবে সাবলীলভাবে। নয়তো শিশুর মধ্যে অসহিষ্ণু আচরণ, প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির মতো অস্বাভাবিক বিষয়গুলো প্রবল হবে। তাই সাধারণভাবে সব শিশুর জন্মের প্রথম ছয় বছর শিশুবান্ধব পরিবেশ, মা–বাবার আদরযত্ন, অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও মেলামেশা করতে দিলে শিশু স্থায়ীভাবে সু-আচরণের অধিকারী হয়ে বেড়ে উঠবে।