শিক্ষাভ্রমণ শিশুর কেন প্রয়োজন
যাঁরা আশি বা নব্বইয়ের দশকে বড় হয়েছেন, তাঁদের স্মৃতিতে স্কুল থেকে দল বেঁধে শিক্ষাভ্রমণ বা শিক্ষাসফরের স্মৃতি উজ্জ্বল থাকার কথা। কেন সেই স্মৃতি এখনো মনে আছে আপনার? সে প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন রকম হতে পারে। তবে একটি সাধারণ কথা সবার জন্য বলা যায়। সেটি হলো, শিশু বয়সের গণ্ডীবদ্ধ জীবনের বাইরে এক অপার কল্পনার রাজ্যে চলে যাওয়া এবং নতুন অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা। আপনার শিশুটির বিষয়েও তেমন একটা পরিবেশ যে তৈরি হওয়া উচিত, সে বিষয়টি ভাবছেন তো? নাকি জিপিএ–৫ পাওয়ার দৌড়ে, ক্লাসে সেরা হওয়ার চাপে বইয়ের ভারে বিপর্যস্ত করছেন আপনার শিশুটিকে?
২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে মহাজাগতিক বিরল ঘটনা পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড় থেকে। ছায়ানটের শিশুশিক্ষার স্কুল নালন্দার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে স্কুলের শিশুদের নিয়ে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখার সে স্মৃতি এখনো স্মরণ আছে আমার। ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সের শখানেক শিশু নিয়ে পঞ্চগড়ে তিন দিনের শিক্ষাভ্রমণে শিক্ষাকর্মীদের দলের একজন হয়ে যেতে পারার অভিজ্ঞতা ছিল অবিস্মরণীয়। যেসব শিশু ওই সূর্যগ্রহণ দেখেছিলেন, তাঁদের চেতনায় এই মহাবিশ্ব নিয়ে কৌতূহল তুঙ্গে উঠছিল। এরপরের ১০ বছরে জিপিএ–৫ পাওয়ার যুদ্ধে নেমে তাঁদের অনেকের মধ্যে সেই কৌতূহল হয়তো এখন আর নেই। ওই সব শিশুর সবাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁদের অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। সেই ভ্রমণ এসব শিশুর চেতনাজগতে যে বিপ্লব ঘটিয়েছিল, সেই প্রভাব তাঁদের মধ্যে এখনো সুস্পষ্ট।
শিশুশিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল মানবিক গুণাবলি অর্জন বা দক্ষ হওয়া নয়। বরং মানব চেতনার পরিপূর্ণ বিকাশ, প্রকৃতি-প্রদত্ত সামর্থ্য ব্যবহারের দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা। আমাদের দেশে শিশুশিক্ষার কর্মযজ্ঞের সঙ্গে ভ্রমণ বা সফরের কোনো সমন্বয় তৈরি করা হয় না। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যে ভ্রমণের আয়োজন করা হয়, তা শিক্ষাভ্রমণ নয়, আনন্দভ্রমণ। আনন্দ যোগ ছাড়া প্রকৃত শিশুশিক্ষা অসম্ভব, কিন্তু শিক্ষাভ্রমণ আর আনন্দভ্রমণ সমার্থক নয়। শিক্ষাভ্রমণ শিশুর নিরানন্দ, নিরাবেগভাবে বেড়ে ওঠার বিরুদ্ধে একটি অসাধারণ পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিত উন্নত দেশগুলোতে।
সুশৃঙ্খল শিক্ষাভ্রমণ থেকে শিশু অনেক কিছু শিখতে পারে। ইতিহাস, সমাজ, বিভিন্ন পেশা-ধর্ম-বর্ণের মানুষ বিষয়ে সচেতনতা, প্রাণ-পরিবেশ বিষয়ে সম্যক ধারণা, সর্বোপরি নিজের গণ্ডীবদ্ধ জীবনের বাইরের জগতের ব্যাপ্তি যে বিশাল, সে বিষয়ে তার একটা ধারণা জন্মায়। সামনের জীবনে ‘যুদ্ধ’ করার জন্য যা প্রয়োজনীয়।
শিশুর মনে ইতিহাস সচেতনতা জাগানোর জন্য ইতিহাসের পাঠ স্কুল পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়েছে। এটি যেমন প্রয়োজনীয় তেমনি ঐতিহাসিক জায়গায় যাওয়া, দেখাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশু যদি পাহাড়পুর বা মহাস্থানগড়ের মতো কোনো ঐতিহাসিক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবার সুযোগ পায়, ঠিক তার পায়ের নিচেই সুপ্রাচীন এক সমৃদ্ধ জনপদ রয়েছে। এই জনপদের একটি অংশ হিসেবে সেখানে একটি বৌদ্ধবিহার ছিল এবং সেই বিহারটি তখনকার বিশ্বের উল্লেখযোগ্য জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিল—তখন তার ভাবনার জগতে এক অন্য রকম অনুধাবন জেগে ওঠে। এই কাজ শ্রেণিকক্ষের হাজারটা ইতিহাসের ক্লাসেও সম্ভব নয়।
এখনকার শিশু বড় হয় নির্জনতার মধ্যে। মা–বাবার বাইরে তাদের বিশ্ব খুবই ছোট। তাদের গাছপালা ছুঁয়ে দেখার সুযোগ কম, জীবজন্তু বা পোকামাকড় দেখে বিস্মিত হওয়ার সুযোগ নেই, বৃষ্টিতে ভেজা নেই, তার অভিজ্ঞতায় হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় উড়িয়ে নেওয়ার উপক্রমের ঘটনা নেই। এই শিশুদের বাস্তুতে নেই বৈচিত্র্যময় সংস্থান। কাজেই জীববিজ্ঞানে এ প্লাস পেলেও প্রকৃতির ইকোলজিক্যাল দর্শন তার উপলব্ধিতে জায়গা পাবে না কোনো দিনই। অথচ কয়েক দিনের একটি সুপরিকল্পিত শিক্ষাভ্রমণ একটি শিশুকে নিয়ে যেতে পারে প্রাকৃতিক সেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে। গন্ধ-শব্দ-স্পর্শের মাধ্যমে জীবজগৎ সম্পর্কে নিজের ভাবনা তৈরির একটি প্রক্রিয়া তৈরি হতে পারে শিশুর মনোজগতে। এসব ঘটনাই তাকে ভবিষ্যতে জীবনযুদ্ধের বিপুল প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখবে।
স্কুলপাঠ্যে বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের বিষয় ছাড়াও সমাজবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞানের মতো আরও কিছু বিষয় থাকে। শিশুশিক্ষার স্কুলপাঠ্যে কৃষিশিক্ষার উদ্দেশ্য ফসল ফলানোর দক্ষতা অর্জন নয়। কিন্তু একজন মানুষের জীবন বাঁচে যে খাবার খেয়ে, তা কোথা থেকে কীভাবে খাবার টেবিলে আসে, কারা এর উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত এসব বিষয়ে শিশুর একধরনের কৌতূহল জন্ম নিতে পারে। আর এই কৌতূহল তার মনে প্রকৃতি ও সমাজের নানা পেশার মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বোধ জন্ম দিতে পারে। বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান পাঠে বিজ্ঞানাগারের গুরুত্ব নিয়ে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই, কিন্তু তা শিক্ষাভ্রমণের বিকল্প নয় কোনোভাবেই। বিজ্ঞানী-দার্শনিক চার্লস ডারউইনের কথা আমরা জানি। তাঁর জ্ঞানচর্চার শুরু হয়েছিল ছোটবেলায় পোকামাকড় পর্যবেক্ষণের অভ্যাস থেকে।
দৃষ্টিসীমা অবারিত হলে এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও নিসর্গ উপভোগের সুযোগ ঘটানো গেলে শিশুদের কল্পনাশক্তি প্রসারিত হতে পারে। চিত্রকলায় যে কল্পনাশক্তির প্রয়োজন, তা শৈশবের প্রকৃতিকে নিজের করে দেখা থেকে শুরুর হতে পারে। এ কারণে শ্রেণিকক্ষে বসে আঁকা ছবিতে সৃজনশীলতা কম এবং কল্পনার বিস্তারও কম।
শিক্ষাভ্রমণের অন্যতম বড় পাওয়া শিশুর আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি হওয়া। দলে ভ্রমণের ফলে অনেকে মিলে ঘুমানো, খাওয়া, স্নান ইত্যাদি করতে হয় বলে এক ভিন্ন ধরনের চর্চার মধ্যে তাকে থাকতে হয়। এই চর্চা তাকে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল, বিনয়ী হতে শেখায়। সহজ জীবনযাপনের হাতেখড়ি হয় দলে চলা থেকে ও বন্ধু বা সহপাঠীদের জীবনযাপন দেখে। এসব কাজের মধ্য দিয়ে শিশুরা ভোগ ও উপভোগকে আলাদা করতে শেখে— জীবনধারণের জন্য যা খুবই দরকারি। অন্যের সুবিধা বিবেচনায় রেখে নিজের সুবিধা খুঁজে নেওয়া চর্চা শুরু হতে পারে সুপরিকল্পিত শিক্ষাভ্রমণ থেকে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বিদ্যালয়ে চার দেয়ালের মধ্যেই শিক্ষা দেওয়া হয়। এই শিক্ষার সঙ্গে যখন শিক্ষাভ্রমণের মাধ্যমে প্রকৃতিপাঠ শুরু হয়, সেটা হয়ে ওঠে শিশুর আনন্দময় শিক্ষা, সুষম শিক্ষা। এই শিক্ষাই শিশুকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে নেতৃত্বগুণে, সৃজনশীলতায়। সমাজ ও প্রকৃতি পাঠের এই শিক্ষাই শিশুকে বিনয়ী করে, সহনশীল করে, জীবনদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তৈরি করে। কাজেই যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশুদের শিক্ষাভ্রমণ নিয়ে আলাদা করে ভাবে, সমাজ ও প্রকৃতি নিয়ে যাদের ভিন্ন চিন্তা ও কার্যক্রম রয়েছে, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের ভর্তি করানোর কথা ভাবুন।
লেখক: শিক্ষাকর্মী, সহজপাঠ উচ্চবিদ্যালয়