২০১৪ সালে দেশে কোলোরেক্টাল সার্জারিতে এম এস হন দুজন। তাঁদেরই একজন ইসমাত জাহান। কোলোরেক্টাল সার্জারিতে তিনিই প্রথম নারী, যিনি এ ডিগ্রি অর্জন করলেন। অন্য অনেক পেশার মতো চিকিৎসা পেশাতেও বাংলাদেশের নারীরা অগ্রসরমাণ। তবে শল্যচিকিৎসায় এখনো নারী চিকিৎসকদের পদচারণ অনেকটাই কম। এ রকম একটা পটভূমিকায় দেশের প্রথম নারী কোলোরেক্টাল সার্জন হওয়ার দুর্লভ গৌরব অর্জন করাটা চাট্টিখানি কথা নয়।
কোলোরেক্টাল সার্জারি অর্থাৎ বৃহদন্ত্র এবং মলদ্বারের শল্যচিকিৎসা যাঁদের প্রয়োজন হয়, তাঁদের কিন্তু বেশ নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আর সমস্যাটা যদি হয় কোনো নারীর, তাহলে পুরুষ চিকিৎসকের কাছে যেতে স্বভাবতই খুব বিব্রতবোধ করেন। কিন্তু নারী চিকিৎসকের কাছে তাঁরা নিঃসংকোচ। তবে কি ইসমাতের কাছে কেবল নারী রোগীই আসেন? না। পুরুষ রোগীরাও আসেন নির্দ্বিধায়। নিজেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটা ঘটনা শোনালেন। একদিন করিডর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে শুনলেন, এক রোগী অপর রোগীকে বলছে, ‘এই সমস্যার সবচেয়ে ভালো ডাক্তার হলেন লিমা ম্যাডাম।’ এই নামেই রোগীদের কাছে পরিচিত ইসমাত জাহান। তাঁর চিকিৎসায় সুস্থ হওয়া রোগীরাই অন্যদের তাঁর খোঁজ দেন। জেনারেল সার্জন হিসেবে ল্যাপারোস্কপিকসহ অন্যান্য অস্ত্রোপচারও করেন তিনি।
জন্ম রাজশাহীতে, বেড়ে ওঠা ঢাকায়। অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয় এবং হলিক্রস কলেজে পড়ালেখা করেছেন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দিতেন মা, নিয়ে যেতেন শিশু একাডেমি ও নজরুল একাডেমিতে। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে পূর্ণ শিক্ষাবৃত্তিতে এমবিবিএস পড়ার সুযোগ পান ইসমাত। সেখানে কাজ করার সময় নারী রোগীদের সংকোচের জায়গাটা উপলব্ধি করেন। তখন থেকেই শল্যচিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছাটা জাগে। বর্তমানে তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। নিজের জীবনের নানা সময়ের গল্প শোনাতে শোনাতে ইসমাত জাহান বলেন, ‘পুরো জীবনে দুজন নারী চিকিৎসককে দেখে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি। একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সালমা সুলতানা, অন্যজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক সামিয়া মুবিন।’
জীবনের সংগ্রামে
সরকারি চাকরির শুরুতে তিন মাস বয়সী সন্তান নিয়ে থেকেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক প্রত্যন্ত উপজেলায়। ছুটি মেলেনি, পুরোটা সময় সঙ্গে পরিবারের বড় কেউ থাকতেও পারেননি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজের ধাপ পেরিয়ে প্রশিক্ষণার্থী পদে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাজ করেছেন। কর্তব্য ফেলে অসুস্থ সন্তানের কাছে যেতে পারছেন না—এমন দিনও পেরিয়ে আসতে হয়েছে। আহত হয়েছে তাঁর মাতৃসত্তা। একাই নিভৃতে কেঁদেছেন। তবু হাল ছেড়ে দেননি। সংসার-সন্তান সামলে সফলভাবে স্নাতকোত্তর করেছেন। এফসিপিএস (জেনারেল সার্জারি) পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পেয়েছেন স্বর্ণপদক। স্বর্ণপদক পাওয়ায় পুরুষ সহকর্মীদের কারও কারও ঈর্ষার শিকারও হয়েছেন।
সাংসারিক জীবনে জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে দারুণ সহযোগিতা পেয়েছেন দুই সন্তানের মা ইসমাত। পেশায় ব্যবসায়ী হলেও দেশের বাইরে পর্যন্ত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সভায় স্ত্রীকে সঙ্গ দেন তিনি। মা, শাশুড়ি এবং ননদের কাছ থেকেও দারুণ সমর্থন পেয়েছেন ইসমাত। প্রায়ই কাজ সেরে ফিরতে রাত হয়ে যায়। মাকে কাছে না পাওয়া নিয়ে সন্তানদের কিছু অভিযোগ রয়েই যায়, তবু মায়ের জীবনধারায় অভ্যস্ত হতে শিখে গেছে তারা।
রোগীর কষ্ট দূর হলে প্রশান্তি পান তিনি। তাঁর কর্মদক্ষতায় রোগী স্বস্তি পাচ্ছেন, এ যেন তাঁর পরম পাওয়া। মানবসেবার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। ইসমাত জাহান বলেন, ‘সাময়িক কষ্টে পড়লেও সততা ও একাগ্রতা থাকলে সাফল্য আসবেই। একজন নারীর আত্মত্যাগের পাশাপাশি পরিবারেরও তাঁকে সমর্থনের মানসিকতা থাকতে হবে। তবেই না সেবা পাবেন বহু রোগী, হেসে উঠবে দেশের হাজার হাজার পরিবার।’