রূপে গুণে অনন্যা সুন্দরী চেরি
‘শ্বশুরবাড়ি মধুর হাঁড়ি’ একটি বাংলা প্রবাদ আছে। এখন আম-জাম-কাঁঠালের মৌসুম। তাজা ফল খেতে এখন শ্বশুরবাড়িতে ডাক পড়বে জামাইদের। সে জন্যই কি শ্বশুরবাড়িকে মধুর হাঁড়ি বলা হয়েছিল? আমরা জানি না। তবে বাংলাদেশের মতো ইউরোপেও ফলের মৌসুম আছে। ইউরোপের সেই মৌসুমে হয়তো আম–জাম পাওয়া যায় না। কিন্তু পাওয়া যায় রসে টসটসে চেরি।
কেক-পেস্ট্রি–জাতীয় বিভিন্ন খাবারের টপিং হিসেবে ঢাকায় দেখা যায় চেরির ব্যবহার। এ ছাড়া অল্পবিস্তর চেরি যে ঢাকা শহরের ফলের দোকানে পাওয়া যায় না, তা নয়। কিন্তু সেগুলো অনেক প্রসেস করা। গাছে পেকে থাকা রসালো তাজা চেরির স্বাদই আলাদা।
এখন চেরির মৌসুম। চেরির মৌসুম খুব অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। ইউরোপের বাজারে এপ্রিলের শেষে চেরি উঠতে শুরু করে, জুলাইয়ের শেষে খুব কমই দেখা যায়। কোমল, সরস ও টসটসে চেরি দেখতেও যেমন দৃষ্টিনন্দন, স্বাদেও তেমন মজার। চেরি প্রকরণভেদে মিষ্টি বা টক-মিষ্টি হয়ে থাকে। একটি চেরির গাছে গড়ে প্রায় সাত হাজার ফল ধরে। জ্যাম, জেলিসহ হরেক পদের কেক তৈরিতে গ্রীষ্মকালীন এ ফলের কদর অনেক বেশি। নানা পদের রান্না ও সালাদে চেরি ব্যবহার করা হয়।
প্রায় বারো শ ধরনের চেরি আছে বিশ্বজুড়ে। এর মধ্যে খুব বেশি হলে মাত্র ২০ ধরনের চেরি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। এই মজার স্বাদের আর উপকারী ফলটির সঙ্গে মানুষের পরিচয়ের ইতিহাস লেখা আছে সেই প্রস্তর যুগের পাথরে। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ ইউরোপ ও এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রাগৈতিহাসিক গুহাগুলোতে চেরি ফলের ফসিলের সন্ধান পেয়েছেন। তবে চেরি ফলের প্রথম লিখিত বর্ণনা পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ বছর আগে, গ্রিক লেখক থিওফ্রাস্টাসের লেখা ‘উদ্ভিদের ইতিহাস’ বইতে। ঠিক একই সময়ে গ্রিক লেখক ও চিকিৎসক ডিফিলাস মূত্রবর্ধক হিসেবে চেরি ফলের উপকারিতার কথা লিখেছিলেন।
মৌসুমি সব ফলেরই কিছু না কিছু গুণ থাকে। পুষ্টিগুণের যাঁরা খবর রাখেন, তাঁরা চেরি ফল খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কারণ,
১. হৃদয় ভালো রাখে
চকচকে উজ্জ্বল বর্ণের চেরি দেখলেই হৃদয় আন্দোলিত হয়। হওয়ারই কথা। কম ক্যালরির এ ফলের সঙ্গে হৃদয়ের সখ্য আছে। কারণ, রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড ও কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদ্রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে এ ফল। মিষ্টি চেরি পলিফেনলস ও পটাশিয়ামের ভালো উৎস। অতিরিক্ত সোডিয়াম অপসারণ করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে চেরি।
২. অমিত লাবণ্যে চেরি
ভিটামিন এ, বি, সি এবং ই-সহ অনেক পদের খাদ্যপ্রাণে ভরপুর, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, পলিফেনলস–সমৃদ্ধ মজার ফল চেরি। ভিটামিন ই ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। ভিটামিন বি রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সহায়তা করে। ভিটামিন সি বার্ধক্য ও চুল পড়া রোধ করে। চর্চিত ত্বকের জন্য চেরিতে আছে খাদ্যপ্রাণ এ। সবকিছু মিলে চেরি আপনার চেহারার রুক্ষতা দূর করে ত্বককে অনেক উজ্জ্বলতা দেবে, চেহারায় এনে দেবে অপার সৌন্দর্য, উচ্ছল লাবণ্য।
৩. সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রশান্তি ও ঘুম
মজার ফল চেরিতে মেলাটোনিন (০.০১৩ মিলিগ্রাম/কেজি) খুব একটা কম নয়। মেলাটোনিন চিন্তা ও উদ্বেগ দূর করে মনে প্রশান্তি আনে। রাতে ভালো ঘুম হয়, শরীর মন সতেজ ও প্রফুল্ল থাকে। তাতেও ত্বক উজ্জ্বল হয়, লাবণ্য বৃদ্ধি পায়।
৪. অস্থিসন্ধির প্রদাহ ও গেঁটে বাতের কষ্ট দূর
রক্তে ইউরিক অ্যাসিড কমায় বলে যাঁরা গেঁটে বাতে কুপোকাত, তাঁরা এই অজুহাতে মজার ফলটি বেশি বেশি খেতে পারেন। প্রাচীন চিকিৎসকেরা এই ফলের এই গুণের কথা জানতেন।
৫. গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) নিচের দিকে
এদিকেও এ ছোট্ট লাল রঙের ফলের সুনাম আছে। ডাক্তাররা সাধারণত যেসব ফলের গ্লাইসেমিক সূচক ৫৫-এর নিচে, সেসব ফল বহুমূত্র, অর্থাৎ ডায়াবেটিস রোগীদের খেতে পরামর্শ দেন। চেরির জি আই ২২। তারপরও একজন চিকিৎসক বা পুষ্টিবিজ্ঞানীর পরামর্শ নেওয়া উচিত হবে ডায়াবেটিস রোগীদের চেরির স্বাদ নেওয়ার আগে।
৬. গর্ভবতীদের জন্য
চেরি প্লাসেন্টা ও ভ্রূণের মধ্যে রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। উপরন্তু ঠান্ডা ও ফুসকুড়ি সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে। আর তা ছাড়া প্রশান্তি আর ভালো ঘুমের জন্য যথেষ্ট মেলাটোনিন তো আছেই।
৭. হজমের জন্য ভালো
খাবার ভালো হজম হলে অনেক রোগ থেকে দূরে থাকা যায়। চেরিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার আছে বলেই অন্ত্রে খাদ্য চলাচল নির্বিঘ্ন করে। ১০টি চেরি ফল দেহকে প্রায় ১.৪ গ্রাম ফাইবারের জোগান দেয়। যা কিনা একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মোট চাহিদার ১০ শতাংশ।
চেরি হৃদয়বান্ধব, প্রশান্তির ঘুম মনকে সতেজ করে, রূপে বাড়তি লাবণ্য ও জৌলুশ আনে, প্রদাহ প্রশমনে কাজ করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও এর সুনাম আছে। অন্ত্র পরিষ্কার করে। রোগ প্রতিরোধে এমন ফলের জুড়ি মেলা ভার। করোনাভাইরাস ঠেকাতে দেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া আর তেমন কোনো কার্যকরী উপায় আজও আমাদের জানা নেই। তাই যাঁদের সুযোগ আছে, তাঁরা এ সময়ে চেরির স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন।
ফরাসিতে একটি জনপ্রিয় প্রবাদ আছে, তা হলো ‘কেকের ওপর চেরি’, অর্থাৎ এমনিই কেক আবার তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চেরি! এ যেন ‘সোনায় সোহাগা’। অন্য সব মৌসুমি ফলের সঙ্গে চেরি যোগ হলে সত্যিই তা হবে বাড়তি পাওনা, একেবারে সোনায় সোহাগা।
সূত্র: Nutrients.2018 Mar; 10 (3) : 368.