রাদিয়া যা দেখেন, আপনি কি তা দেখেন?
‘আমি যা দেখি, তুমি কি তা দেখো?’—ছোটবেলায় এই খেলা অনেকেই খেলেছেন। ওই যে একজন কিছু একটা দেখল, যেটা হুট করে চোখ এড়িয়ে যায় বা সহজে খুঁজে পাওয়া কঠিন। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আরেকজনকেও সেটা খুঁজে বের করতে হয়। এই হলো খেলার নিয়ম। ছোটবেলায় এটাই ছিল রাদিয়ার প্রিয় খেলা। বড় হয়েও একই খেলা খেলছেন, তবে একটু অন্যভাবে। ক্যামেরায় চোখ রেখে রাদিয়া এমন কিছু দেখার চেষ্টা করেন, যা সাদা চোখে ধরা পড়ে না। তাই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) ইংরেজি সাহিত্যের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাদিয়া ইসলাম শুধু আলোকচিত্রীই নন, তিনি শাবিপ্রবির ফটোগ্রাফারস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট।
‘ছবি তুলতে কেন ভালোবাসেন?’ প্রশ্নের উত্তরে রাদিয়া বলেন, ‘আমার যখন আট বছর বয়স, সেই আমি আর এখন নেই। কিন্তু ছবিটা ঠিক ও রকমই আছে। আমরা যেমন বরফ-পানি খেলি। ক্যামেরা সময়টাকে “বরফ” করে ফেলে। তাই একটা সময় থেকে দূরে চলে আসার পরও ওই সময়টায় ফেরা যায়।’ আট বছর বয়সের প্রসঙ্গ এল, কারণ সে সময়ের কথাই হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। রাদিয়ার যখন আট, তখন বাবা রাদিয়ার বড় বোনকে একটা সিক্সটিন মেগাপিক্সেলের ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে দেন। রাদিয়া একবার কোনোমতে সেই ক্যামেরা হাতে পেলে কিছুতেই ছাড়তে চাইতেন না।
কলেজে ওঠার পর একরকম অলিখিতভাবেই বড় বোনের ক্যামেরার পুরো দখল নিয়ে ফেললেন। শহীদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজের আনাচ–কানাচ বন্দী হয়েছে সেই ক্যামেরায়। তারপর শাবিপ্রবিতে পা রেখেই প্রথমে যা খুঁজলেন, তা হলো আলোকচিত্র নিয়ে কাজ করে এমন একটা দল। আলোকচিত্রবিষয়ক কর্মশালায় অংশ নিলেন। দুই ধাপে প্রকাশিত হলো ফলাফল। সেখানে তাঁর তোলা ছবি প্রথম হলো আর মেধাতালিকায় তিনি হলেন তৃতীয়। ঢুকে পড়লেন শাহজালাল ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফারস অ্যাসোসিয়েশনে।
সেখানে কী হতো? ‘শনি, রোববার ফটোওয়াক হতো। যে যার পছন্দমতো ছবিগুলো জমা দিত। কোনটা কার ছবি, কেউ জানত না। বৃহস্পতিবার জমা পড়া ছবিগুলো নিয়ে মুক্ত আলোচনা চলত। কেবল “সপ্তাহের সেরা ছবি” প্রকাশ করা হতো নামসহ। যেদিন আমার ছবির ব্যাপক সমালোচনা হতো, হাসাহাসি হতো, জিজ্ঞেস করত, এটা কার ছবি? আমি চুপ করে বসে থাকতাম।’
এভাবেই একদিন হাঁটি হাঁটি পা পা করে এল ‘ইনকুয়েস্ট ইনসাইট: অ্যান ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি এক্সিবিশন’। এই প্রদর্শনীর জন্য প্রত্যেকে দুটো করে ছবি জমা দিতে পারবে। তখন চলছিল দুর্গাপূজা। রাদিয়ার মনে হলো, দুর্গাকে মানুষ সম্মান করে। অথচ নারীর পথচলা কত কঠিন, সেখানে পদে পদে কত অসম্মান, বৈষম্য সইতে হয়। বিষয়টি ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন তিনি। অনেক ঝক্কির পর মনমতো একটা ছবি তোলা গেল—পানিতে ভাসছেন এক তরুণী। দেবীর মতো সাজ। ছড়ানো চুল। মুখে আঘাতের চিহ্ন।
হুট করে আরেকটি ছবির ভাবনা এল রাত বারোটায়। সেই ছবির জোগাড়যন্ত্র কম নয়। মনে মনে ডিজাইন করলেন রাদিয়া। ছবিটা তুলতে প্রয়োজন একটা সোয়েটার, ছোটদের জুতা, মোজা আর একটা বিড়ালের বাচ্চা। রাতের মধ্যেই সব ঠিকঠাক করে সকাল আটটায় শুটিংয়ে নামেন তিনি। কী বোঝাতে চেয়েছিলেন এই ছবির মাধ্যমে?
‘বিড়াল তো এমনিতে একটু দুষ্টু প্রকৃতির প্রাণী। এখানে আমি একটু মজা করে মানুষের একটা প্রকৃতি বোঝাতে চেয়েছি। যে মানুষেরা বাইরে থেকে খুবই “ইনোসেন্ট”। কিন্তু মাথার ভেতর ঘোরে দুষ্টুমি। তাই ঠিক ঘাড়ের ওপর মাথার জায়গাটায় বিড়ালটা ঘাপটি মেরে বসে আছে। ছবির ভেতরে আসলে একটা সারপ্রাইজ আছে। হঠাৎ চোখ পড়লে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরানো যায় না। আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হয়,’ বললেন রাদিয়া। দুটো ছবিই নির্বাচিত হয় প্রদর্শনীর জন্য। আর বিড়ালের ছবিটি স্থান পায় সেরা দশে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে তাঁর ক্যামেরায় ‘স্থির হয়ে যাওয়া’ রাস উৎসবের নাচের ছবি। এসব ছবির সুবাদে কয়েকটি পুরস্কারও এসে জমা হয়েছে রাদিয়ার ঝুলিতে। তবে ছবি তোলার খেলাটা জারি রাখার জন্য এই বিষয়ে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে চান তিনি। পড়াশোনার ফাঁকে ছবি তোলা, কিংবা ছবি তোলার ফাঁকে পড়াশোনা...এভাবেই কাটছে রাদিয়ার দিনরাত্রি।