রাকাদের সমযাত্রা
আমার অগ্রগণ্য সহকর্মীদের মধ্যে অন্যতম একজন রাকা নোশিন নাওয়ার। আপাতদৃষ্টিতে ছোটখাটো মানুষ, অসাধারণ প্রাণশক্তিতে ভরপুর। রাকা সম্ভবত ইংরেজি শব্দ ‘কালারফুল’–এর সমার্থক। কিন্তু এসবের আড়ালে রাকার একজন পুরোনো সহকর্মী হওয়ার সুবাদে আমার হয়তো ওর ভুবন সম্পর্কে খানিকটা বেশি জানা।
হলিক্রস স্কুল এবং কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী রাকা এই মুহূর্তে পেশায় একজন বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা হলেও পড়াশোনার সূত্রে একজন প্রকৌশলী। বেশ কিছু বছর আগে আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে রাকা যখন আমাদের ভুবনে নিছক কৌতূহলবশত আসত, তখনো হয়তো জানত না ভবিষ্যৎ তার জন্য কী নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিজ্ঞাপন নির্মাণে আমরা যারা জড়িত, তাদের মধ্যে আলাদা একটা জায়গা রাকার প্রাপ্য।
আমাদের প্রতিষ্ঠান অ্যাপলবক্স ফিল্মসে রাকার বেড়ে ওঠা ও একজন পরিচালক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, এই মাধ্যম নিয়ে ওর নিরন্তর জানার চেষ্টা এবং সেটা ওর কাজে প্রয়োগ করা। রাকা একজন প্রকৌশলী বলেই সম্ভবত বিশ্লেষণক্ষমতা এবং কাজের সমন্বয় ও খুব যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে, যেটা ওর শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করে। বিজ্ঞাপন হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং দলগত প্রচেষ্টার একটা সমন্বিত চর্চার ক্ষেত্র। আর সেখানেই রাকার বৈশিষ্ট্য—ও সবচেয়ে অনুল্লেখযোগ্য বিষয়টাকেও ভীষণ যত্ন নিয়ে তৈরি করে। ছোট হোক আর বড় হোক, যেকোনো কাজই সমান যত্নে আর সমান মমতায় ওর গল্প বলায় হাজির করে। এত তরুণ বয়সে ওর কাজে যে ধরনের স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রয়েছে, সেটা ওকে সামনের দিনগুলোতে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেবে বলেই আমার বিশ্বাস।
বিজ্ঞাপনের সর্বগ্রাসী ঝক্কিঝামেলা আর চাপ সামলে টিকে থাকা এক ধরনের নিরন্তর সংগ্রামই বলা চলে। নারীদের জন্য সব প্রকার বিবেচনা মাথায় রেখে বলতে পারি, এই যাত্রা মোটেও মসৃণ নয়। রাকার জন্যও বোধ করি সেটাই প্রযোজ্য। আমার সহকর্মী একজন নারী বটে; এখন সময়, প্রেক্ষিত আর অভিজ্ঞতার বিবেচনায় এও বলা যায়, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আর সফলতার অনেক উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদের আশপাশে থাকলেও রাকারা এখনো ‘সংখ্যালঘু’। শুধু সংখ্যার বিচারে নয়, সামগ্রিক বিচারে। আমরা যখন মেয়েদের মধ্যে ‘ও ভালো করছে’ পর্যায় অতিক্রম করার চেষ্টা করছি, তখন রাকা এবং রাকার মতো যারা—তারা অনেকটাই এগিয়ে।
রাকার শুরুটা এমন নয় যে একটা বিশেষ কাজ ওকে হঠাৎ করে ওর জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। বরং নতুন ভাবনা আর প্রযুক্তি দিয়ে ও নিজের মতো করে কাজ করতে শুরু করে। কাস্টিং ভিডিও থেকে ভ্রমণের ভিডিও, আমাদের অফিসে শিক্ষা কার্যক্রমের প্রোমো, অথবা অন্য পরিচালকদের কাজে সাহায্য করে সব সময় রাকা ওর আগ্রহ জানান দিয়েছে। আর যা ওকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে, তা হলো যেকোনো কাজে শেষ পর্যন্ত লেগে থাকা। যখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম রাকা অ্যাপলবক্স ফিল্মসে একজন পরিচালক হিসেবে পেশাদার কাজ শুরু করবে—একটা জিনিস আমি নিশ্চিত ছিলাম, শুরু করলে ওকে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। ওর কাজের ধরনের বৈশিষ্ট্যই হলো, নিজের ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষর ও প্রতিটা বিভাগে রাখতে সক্ষম। সব মিলিয়ে ওর প্রাণশক্তি সব সময় ক্রুদের জন্য আলাদা করে রোমাঞ্চ আর আনন্দ বয়ে আনে। এখন রাকা বিভিন্ন নামীদামি ব্র্যান্ডের প্রচারণায় বিজ্ঞাপন নির্মাণের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে।
আমি বলব, রাকার কাজে, জীবনবোধে একটা ‘ফিউশন অ্যাপ্রোচ’ আছে, যেটা ওর প্রজন্মের একটা বৈশিষ্ট্য। বেড়ে ওঠা, সংগীত ও সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাকার দেখার ভঙ্গি তৈরিতে সাহায্য করেছে। কিন্তু তার চাইতেও বড় ব্যাপার, সচেতন কিংবা অবচেতন মনেই ওরা নিজেদের সময়টাকে সম্ভবত আমাদের চেয়ে অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারে। আজকের দিনের একজন নারীর জন্য ‘বক্তব্য বনাম করে দেখানোর’ সংস্কৃতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া আমি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করি।
রাকা এবং রাকার মতো যারা, তাদের সবচেয়ে বড় সক্ষমতা হচ্ছে ওরা নিজেদের জ্ঞান আর কাজ করে দেখানোর অদ্ভুত সমন্বয় নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। রাকার বয়স আর কাজের বিচারে নিশ্চয়ই বলা যায়, সময়টা যখন একান্তই ওর আর ওদের মতো হবে, তখন ওদেরকে আর ‘সংখ্যালঘু’ বলতে হবে না।
অ্যাপলবক্স ফিল্মসে আমরা একটা ব্যাপার সচেতনভাবেই করি, সেটা হলো রাকাদের নিজের স্বাভাবিক ক্ষেত্রে ছেড়ে দেওয়া, ওরা যেন নিজের মতো করে নিজের রাস্তা তৈরি করে নেয়। ‘সাহায্য’ শব্দে আমার ভীষণ আপত্তি, ওদের সাহায্যের দরকার নেই। ওদের দরকার ওদের মতো করে নিজেদের প্রকাশ করা। আমাদের কাজ হলো, আমাদের নারী সহকর্মীদের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা আর তাদের স্বাতন্ত্র্যকে শ্রদ্ধা করা। এই মুহূর্তে অ্যাপলবক্স ফিল্মসের মূল চালিকা শক্তির ৭০ শতাংশই নারী।
রাকাদের সমযাত্রায়, সমব্যথী হিসেবে নারী দিবসের শুভেচ্ছা। সংগ্রাম নিরন্তর। রুমা গুহঠাকুরতার গানের একটা কথা দিয়ে সমাপ্তি টানি, ‘আজ নয়, কাল নয়, পরশু আশাবরী ফুল তো ফুটবেই।’
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, অ্যাপলবক্স ফিল্মস লিমিটেড