মেয়েকে কোলে নিয়েই ক্লাস
নুসরাত নুসাইবার বয়স মাত্র ২২ মাস। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিয়ত যাতায়াতে সে এখন বলতে গেলে অনেকের কাছেই পরিচিত মুখ। সে তার মা নার্গিস আক্তারের সঙ্গে ক্লাসে যায়। সকাল বা বিকেল, টানা তিন ঘণ্টা মায়ের সঙ্গে ক্লাস করে। বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবার বাসায় যেতে লেগে যায় প্রায় এক ঘণ্টা।
নার্গিস আক্তার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি জানালেন, তিন–চার মাস ধরে মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন। আগে বাসায় নিজের মায়ের কাছে মেয়েকে রাখার সুযোগ ছিল, মা বাড়ি চলে যাওয়ায় এ পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
সকাল বা বিকেল, যখনই ক্লাস থাকে, নার্গিস মেয়ের জামাকাপড়, খাবার, পানি, চিপস সব নিয়ে বের হন। মেয়ে ক্লাসে ঘুমিয়ে গেলে কোলে নিয়েই চলে পড়াশোনা। মেয়ে কান্নাকাটি শুরু করলে যাতে অন্যদের বিরক্ত না করে, তাই ক্লাস থেকে বের হওয়া যান। নার্গিস পেছনের বেঞ্চে বসেন। কান্নাকাটি শুরু করলে মেয়েকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে যান। কান্না থামলে আবার ফেরেন ক্লাসে।
শিক্ষক বা অন্য সহপাঠীরা বিরক্ত হন না প্রশ্নের উত্তরে নার্গিস বলেন, ‘শিক্ষক এবং অন্যরা সহযোগিতা করেন বলেই তো মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাই। শিক্ষকেরা মেয়েকে নিয়ে যেতে নিষেধ করলে আমার পড়াই বন্ধ হয়ে যাবে।’
কুমিল্লার ভাড়া বাসায় মেয়েকে নিয়ে নার্গিস একাই থাকেন। নার্গিসের স্বামী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সৈনিক পদে কর্মরত। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েকে নিয়ে ক্লাস করা সম্ভব না, আবার স্বামীর কাজের সুবিধার জন্যও তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে থাকতে হয়। তাই মা মেয়েকে নিয়ে এই সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ে নার্গিসের বিয়ে হয় একাদশ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। স্বামীর উৎসাহেই পড়াশোনা বন্ধ হয়নি। ঢাকায় হোস্টেলে থেকে কোচিং করেছেন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। এর মধ্যে মেয়ের জন্ম হলেও থেমে যাননি নার্গিস। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, একটু আরামে থাকাসহ কিছু বিষয় জীবন থেকে বাদ দিতে হলেও নার্গিসের কোনো দুঃখ নেই। তিনি পড়াশোনা শেষ করে সাংবাদিক হতে চান।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক কাজী আনিছ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই শিক্ষার্থী তার মেয়েকে নিয়ে ক্লাসে আসে। মা ও মেয়ে অনেক কষ্ট করছে। আমরা অবাক হই এই মায়ের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে। ক্লাসে মেয়ে কান্নাকাটি করলে মাঝেমধ্যে আমি ওকে কোলে নিয়ে ক্লাস করাই। এভাবেই চলছে মা ও মেয়ের সংগ্রাম।’